ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : চলমান সংঘাত ও বর্তমান পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪
ছবি : সংগৃহীত
বছরজুড়ে সারাবিশ্বে সবচেয়ে আলোচনা-সমালোচনায় রয়েছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত। চলমান এই সংঘাতে ইতোমধ্যে ৪৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দেড় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি। হতাহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘকালীন, জটিল এবং সহিংস সংকট। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা নেয়। বর্তমানে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েলের দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে। অপরদিকে ইসরায়েল তাদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং, ক্ষমতা ও দখলদারিত্ব বজায় রাখতে এই সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের পেছনে দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক কারণ রয়েছে। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা এবং ব্রিটিশ ম্যান্ডেট পরবর্তী সময়ে ইহুদি অভিবাসন এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এ কারণে, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, বর্তমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের শুরু ১৯৪৮ সালের পর হলেও এর মূল সূত্রপাত ১৯১৭ সালের পর থেকেই।
২০ শতকের শুরুতে যখন ইউরোপীয় ইহুদিরা ফিলিস্তিনে অভিবাসন শুরু করে এবং সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করে তখন থেকেই মূলত এই সংঘাতের সূত্রপাত। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চলে ইহুদি বসতি স্থাপন বাড়তে থাকে। ফলে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা এর বিরোধিতা করতে শুরু করে।
এর পরপরই ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ সিদ্ধান্ত ইহুদিরা মেনে নিলেও ফিলিস্তিনিরা ও আরব দেশগুলো তা প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অথবা আদেশপত্র শেষ হওয়ার আগেই ইহুদি রাষ্ট্রের সম্প্রসারণে ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রাম ধ্বংস করতে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল।
১৯৪৮ সালের এপ্রিলে জেরুজালেমের উপকণ্ঠে দেইর ইয়াসিন গ্রামে ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম শহর ধ্বংস করা হয়েছিল। যাকে ফিলিস্তিনিরা আরবি ভাষায় ‘নাকবা অথবা বিপর্যয়’ হিসেবে উল্লেখ করে। গণহত্যায় কমপক্ষে ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
ইহুদিরা সে সময় ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ দখল করেছিল। আর অবশিষ্ট ২২ শতাংশ বর্তমানে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। এই ‘নাকবা’ বা ‘ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয়’-এর পর থেকেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে।
১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল, মিশর, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা শেষ হয়। কিন্তু শেষ হয় নি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব।
১৯৬৭ সালের ৫ জুন আরব সেনাবাহিনীর একটি জোটের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস ও মিসরের সিনাই উপদ্বীপসহ ফিলিস্তিনের বাকি অংশ দখল করে। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘দ্বিতীয় জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি বা নাকসা’ নামে পরিচিত। সে সময় অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায়ও বসতি স্থাপন শুরু করেছিল ইসরায়েলিরা।
পরবর্তীতে গাজায় ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে চারটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক হামলা করেছে ইসরায়েল। হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও কয়েক হাজার বাড়ি, স্কুল ও অফিস ভবন ধ্বংস হয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
তবে সেসময় যুদ্ধবিরতি হলেও তা ছিল সাময়িক। সময়ের সাথে সাথে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলা এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নেয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের উপর স্থল, সমুদ্র এবং বিমান হামলা করে। এই হামলায় ইসরায়েলের ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। এ সময় ২৪০ জনেরও বেশি ইসরায়েলিকে জিম্মি করে হামাস।
এই হামলার পর থেকে গাজা, পশ্চিম তীরসহ সমগ্র ফিলিস্তিনের ওপর ক্রমাগত হামলা করতে থাকে ইসরায়েল। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রমাগত ঘটে চলা এই হামলার কারণে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চলছে সর্বাত্মক মানবিক বিপর্যয়। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সংঘর্ষ দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। এই হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
বর্তমানে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫ হাজার ছাড়িয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। শুধু ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষই নয়, এই সংঘাতের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক, ডাক্তার-নার্সসহ মানবাধিকার সহায়তাকর্মীরাও। ইসরায়েলি এই হামলায় গাজা উপত্যকার হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, গাজা উপত্যকা জুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরায়েল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের ক্রমাগত আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। গত মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। কিন্তু তবুও গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা থামছে না।
এর আগে ১৯৯৩ সালের ওসলো চুক্তি এবং পরবর্তীতে কিছু শান্তি প্রক্রিয়া চেষ্টা করা হলেও তা স্থায়ী সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে তীব্র সহিংসতার প্রেক্ষাপটে শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনও বহু দূরের ভাবনা। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে আন্তর্জাতিক সমাজও চিন্তিত। সবাই এই দ্বন্দ্বের স্থায়ী সমাধান দাবি করছে।
এদিকে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সমর্থন জানিয়ে আসছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আসন্ন ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী প্রতিশ্রুতিতে ট্রাম্প ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধ করতে কাজ করবেন বললেও প্রত্যক্ষভাবে ইসরায়েলের বন্ধু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধে কী পদক্ষেপ নেবে তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে।
ইসরায়েল ও হামাস দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বহুবার আলোচনা হলেও দৃশ্যত কোনও স্থায়ী সমাধান এখনো পর্যন্ত হয়নি। গত মাসে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় সম্মত হয়েছে হামাস। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আলোচনা কার্যকর করতে আগ্রহী। এমতাবস্থায়, এই দুই অঞ্চলের মধ্যকার যুদ্ধ পরিস্থিতির আদৌও কোন সমাধান আসবে কি না তা আপাতত সময়ের অপেক্ষায়।
এসবি