২০২৪
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা জুড়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:২৬
বিশ্বজুড়ে নানা পরিবর্তন, উত্তেজনা আর চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলেছে ২০২৪ সাল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কেমন ছিল এই বছর? এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত একটিই। নানা সম্ভাবনা আর আশা নিয়ে শুরু হওয়া চলতি বছর শেষ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশ্ন মাথায় রেখে। এই বছর বিশ্বজুড়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর যুদ্ধ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। অনেক আশঙ্কা তৃতীয়বারের বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আমাদের এই পৃথিবী।
এই আশঙ্কা যে একেবারেই অমূলক না তা গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট আর বিভিন্ন প্রান্তে চলমান যুদ্ধ-সহিংসতার দিকে তাকালেই বুঝা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান এসব যুদ্ধ-সংঘাত নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে থাকছে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত-উত্তেজনা।
গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতা
২০০৭ সালে হামাস গাজার ক্ষমতায় আসে। আর এরপর থেকে গাজাবাসীর উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকে ইসরায়েল। হামাস ইসরায়েলকে একেবারে অস্বীকার করে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ইসরায়েল হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করে হামাস। আর এরপরেই ইসরায়েলের পাল্টা হামলা চালায় গাজা উপত্যকায়। হামাসকে শেষ করার নামে এক ভয়াবহ অসম যুদ্ধে নামে ইসরায়েল। এই এখন পর্যন্ত নিহতের মোট সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৪৫ হাজার ৪৮৪ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ৮ হাজার ৯০ ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলের নৃশংসতার কারণে গাজা এখন বিশ্বের গোরস্তানে পরিণত হয়েছে। গাজা যুদ্ধে হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া ইরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। এরপর গাজার ভূখণ্ডে থাকা হামাসের অপর শীর্ষ নেতা ইয়াহইয়া সিনওয়ার যুদ্ধ করতে করতে মারা যান।
ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। এই হামলার শিকার অধিকাংশই নারী ও শিশু। গাজার অধিকাংশ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যদিও ইসরায়েলের দাবি, যুদ্ধে তাদের পনের শর বেশি মানুষ নিহত ও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে।
গাজায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে নিহত ও আহত হয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক সহায়তাকর্মী। গাজা যুদ্ধে বিভিন্ন পক্ষ জড়িয়ে পড়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বজুড়েই সামগ্রিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বহুবার আলোচনা হলেও দৃশ্যত কোনো স্থায়ী সমাধান এখনো পর্যন্ত হয়নি। সম্প্রতি ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় সম্মত হয়েছে হামাস। সর্বশেষ গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনা করতে হামাসের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক করেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি। বৈঠকের সময় গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে এমন একটি স্পষ্ট এবং ব্যাপক চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভবিষ্যৎ ট্রাম্প প্রশাসন একটি চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছে। এমনকি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই যেন সেটা হয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, আরব আমিরাত গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির জন্য কয়েক মাস ধরে ব্যর্থ আলোচনা চালিয়েছে।
গত নভেম্বরে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানালেও ডিসেম্বরে আবারও ফেরার ঘোষণা দেয় কাতার।। এরপরই হামাসের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি জানা গেল।
এদিকে গাজায় হামাসের হাতে জিম্মিদের উদ্ধার করতে একটি চুক্তি সইয়ের দাবিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে শনিবার রেকর্ড সংখ্যক মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে গাজা যুদ্ধ বন্ধ এবং জিম্মি মুক্তি নিয়ে হামাস ও ইসরায়েল উভয় পক্ষই আলোচনায় অগ্রগতির কথা জানিয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত একমত হতে পারেনি।
ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ
লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সাথে ইসরায়েলের দীর্ঘদিন ধরেই। শিয়া ইসলামিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ১৯৮২ সালে ইরানের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরায়েলকে একটি অবৈধ রাষ্ট্র হিসেবে দেখে তারা। ইসরায়েলও হিজবুল্লাহকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
২০০৬ সালের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের পর থেকে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা এবং পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটছে। যদিও তখন একটি যুদ্ধবিরতি হয়েছিল কিন্তু তা খুব একটা ফলপ্রসু হয়নি। এদিকে সিরিয়া যুদ্ধের পর, হিজবুল্লাহ ইরানের মিত্র হিসেবে সিরিয়ায় সক্রিয় থাকায়, ইসরায়েল এই অঞ্চলে হিজবুল্লাহর উপস্থিতি এবং ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রতি বিরুপ।
আর গাজায় অভিযানের পর হিজবুল্লাহও ইসরায়েল সীমান্তে হামলা হামলা চালায়। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হয় পেজার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ বেশ কয়েকটি শহরে একযোগে এসব বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক শিশুসহ অন্তত ১২ জন নিহত ও আরও ২৭৫০ জন আহত হন। হতাহতদের অধিকাংশই হিজবুল্লাহর যোদ্ধা।
পাল্টা আক্রমণের ফলে লেবানন জুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই যুদ্ধের ফলে বহু বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক, বাস্তুচ্যুতি ও মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে লেবাননের দক্ষিণ অঞ্চলে। দুই পক্ষের মধ্যে এই সংঘাতের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি মানবিক সঙ্কটও বৃদ্ধি পেয়েছে। লেবানন কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসরায়েলের হামলায় লেবাননে ৩ হাজার ৮০০ জন নিহত হয়েছেন। যুদ্ধে লেবাননের ৯৯ হাজার বাড়িঘর আংশিক ও পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এছাড়া, ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ গড়ে তোলার পর তাদের যোদ্ধারা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ১৪ মাসের সংঘাতে হিজবুল্লাহ প্রায় ৪ হাজার যোদ্ধা হারিয়েছে। যা ২০০৬ সালের যুদ্ধের চেয়ে ১০ গুণ বেশি।
অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি গত ২৭ নভেম্বর কার্যকর হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৬০ দিন মেয়াদে এ চুক্তি করা হলেও পরে মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৬০ দিনের মধ্যে ইসরায়েল লেবানন থেকে সরে যাবে এবং হিজবুল্লাহর পরিবর্তে লেবাননের সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে। তবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার একদিন পরেও ইসরায়েলি ড্রোন বৈরুতের আকাশে ঘুরতে দেখা যায় এবং তাদের হামলা অব্যাহত ছিল।
তবে হিজবুল্লাহ নিজেদের এ লড়াইয়ে জয়ী বলে মনে করছে। পাশাপাশি লেবাননের বাসিন্দারাও জয়ের অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। শীর্ষ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর এখনো নতুন নেতা পেতে হিমশিম খাচ্ছে সংগঠনটি। দক্ষিণ বৈরুতে ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহ সমর্থক বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে পুনরায় সংগঠিত হওয়াই এখন হিজবুল্লাহর মূল লক্ষ্য। তাদের নেতার মৃত্যুর পর নতুন নেতা পাওয়ার চেষ্টা চলছে এবং নিরাপত্তা ত্রুটির কারণে ইসরায়েল ব্যাপক আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়েছে। হিজবুল্লাহ এখন তাদের শহীদদের শেষ বিদায় জানানো, ধ্বংসস্তূপ সরানো এবং পুনর্গঠন নিয়ে ভাবছে।
হাসান ফাদাল্লাহ নামে হিজবুল্লাহর এক জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তারা যেসব বিষয় নিয়ে ভাবছেন, তা হলো লোকজনকে কীভাবে পুনর্বাসন করবেন, কীভাবে ধ্বংসস্তূপ সরাবেন, কীভাবে শহীদদের শেষ বিদায় জানাবেন। পরে তারা পুনর্গঠন নিয়ে ভাববেন।
এদিকে হিজবুল্লাহকে সংস্কারের জন্য সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইরান। সেই সাথে বিশ্বব্যাংক লেবাননের বাড়িঘর সংস্কারে ২৮০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছে। তবে অনেকেই ধারণা, ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের শেষ নয়, বরং শুধু বিরতি। আপাতত ৬০ দিন মেয়াদের এই যুদ্ধবিরতি, স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে পরিণত হবে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ইসরায়েল-পশ্চিমতীর
ইসরায়েল নিজেকে একটি ইহুদীবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবী করলেও বিশ্ববাসীর কাছে ইসরায়েল ‘পৃথিবীর বিষফোঁড়া’ নামেই সুপরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে ইসরায়েল এক দুঃস্বপ্নের নামান্তর। ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের শেষে জাতিসংঘের সুপারিশে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়। যা মূলত ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার জন্য করা হয়েছিল। তবে, এরপর থেকে ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা এ ধারণাটি সমর্থন করে আসছেন এবং পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান হাইটসসহ অন্যান্য অঞ্চলে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে।
‘প্রমিজড ল্যান্ড’ বা ‘প্রতিশ্রুত ভূখণ্ড’ ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজেদের বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ধারণাটি ইসরায়েলি রাজনীতির একটি বিতর্কিত বিষয়। এই ধারণার অনুযায়ী ইসরায়েল মনে করে, ইসরায়েলি ভূমি মিশরের নীল নদ থেকে ইরাকের ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া উচিত। যার মধ্যে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, মিশর, তুরস্ক ও সৌদি আরবও অন্তর্ভুক্ত। এই ধারণা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরু হয়।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম, ইতিহাস ও রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে বেশ কয়েকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটি ১৯৬৭ সাল থেকে অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা সামরিকভাবে দখল করে আছে। এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবে আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম সামরিক দখলের ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়।
২০১৭ সালে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবৃতি দেয় যে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখল, ছয় লাখ ইহুদীর জন্য ২৮০টির মতো (আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে) অবৈধ বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদের পাশাপাশি অবাধ বৈষম্যমূলক আচরণের দ্বারা প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদেরকে কর্মস্থলে গমন, বিদ্যালয়ে গমন, বিদেশে গমন, আত্মীয়দের সাক্ষাৎ, অর্থ উপার্জন, প্রতিবাদে অংশগ্রহণ, কৃষিভূমিতে কাজ করার ক্ষমতা, এমনকি বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানি লাভের মতো মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে চলেছে।
২০২১ সালে এসে জাতিসংঘের ১৯২টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১৬৪টি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ২৮টি রাষ্ট্র (মূলত মুসলমান অধ্যুষিত) এখনও ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়নি। এর সাথে তাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাদের মতে, ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের একটি অংশের অবৈধ দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড। তবে, নিকটতম দুই আরব প্রতিবেশী মিশর ও জর্দানের সাথে ইসরায়েল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং দেশ দুইটির স্বীকৃতিও লাভ করেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাদের আগ্রাসন কমানোর কোন উদ্যেগ তারা নিতে নারাজ।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে ঐতিহাসিক গবেষণা ও দালিলিক যুক্তিপ্রমাণসহ দাবি করা হয় যে ইসরায়েলি সরকার ইহুদীদেরকে অগ্রাধিকার দেয় এবং অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। চলতি বছর বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা সব যুদ্ধ-সংঘাতের সিংহভাগের জন্য দায়ী ইসরায়েল। যার সব আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন তেলক্ষেত্র, স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলার ফলে বিশ্ব জুড়ে জ্বালানিসহ অর্থনৈতিক সংকট দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে।
ইরান-ইসরায়েল
এদিকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে হামলা-পাল্টা হামলা চলছে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে। দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় ওই ভূখণ্ডকে অধিকৃত ফিলিস্তিনের অংশ হিসেবেই অভিহিত করে ইরান। আর মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে থাকা ইরানের প্রক্সিযোদ্ধারা সুযোগ পেলেই ইসরায়েলে হামলা চালায়। ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের সহায়তা করে ইরান।
গত ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের হামলায় সাবেক হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ ও বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডার আব্বাস নিলফোরোসানসহ আরও বেশকয়েকজন শীর্ষ ইরানপন্থী নেতা নিহত হন। এর জবাবে গত ১ অক্টোবর দখলদার ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে ইরান। ইসরায়েলের বিমান ঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করেই ছোঁড়া হয় এসব ক্ষেপণাস্ত্র। হামলার পর শিয়া অধ্যুশিত দেশটি আবার হুঁশিয়ারিও করেছিল, যদি ইসরায়েল ভুল কিছু করে- প্রতিশোধ আরও জোরদার হবে।
ইরানের হুঁশিয়ারিকে পাত্তা না দিয়ে গত ২৬ অক্টোবর ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় তিন দফা জঙ্গি বিমান হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল। এতে ইরানের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও এবার ইসরায়েলকে পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান। ইরান এখন কী ব্যবস্থা নেবে সেটির দিকে নজর রাখছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমাদেশগুলো পাল্টা হামলা না চালাতে ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলেও বর্তমানে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনা কম। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের পাল্টা বিমান হামলা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। তবে উভয় দেশই সংঘাতের পথে না গিয়ে কূটনৈতিক পদক্ষেপে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এদিকে, ইসরায়েল পশ্চিমা মিত্রদের মাধ্যমে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে তার অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইরান তা প্রতিহত করার জন্য কৌশলগতভাবে ইরাক এবং অন্য মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখছে। এই পরিস্থিতিতে, কোনো দেশ যদি আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসে, তাহলে বৈশ্বিক শক্তির সমর্থন পেলে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হতেও পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইয়েমেন-ইসরায়েল সংঘাত
ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নভেম্বর থেকে ইয়েমেন উপকূল সংলগ্ন লোহিত সাগর, এডেন উপসাগর আরব সাগরে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে হামলা চালাচ্ছে হুতিরা। তাদের দাবি, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলি জাহাজ বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজগুলোতে হামলা চালাচ্ছে তারা।
হুতি বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে বছরের শেষ দিকে ইয়েমেনে বড় ধরনের হামলা চালায়। যাতে ৯ জনের মতো মারা যায়। ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ বন্দর ও জ্বালানি অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় এসব হামলা হয়। হুতি বিদ্রোহীদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে এ হামলা চালায় ইসরায়েল।
হুতি বিদ্রোহীরা এর আগে জানিয়েছিল, তারা ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলীয় শহর জাফার একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এ নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা ইসরায়েল লক্ষ্য করে দু’টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইরানের সমর্থন পাওয়া ইয়েমেনের হুতিরা ইসরায়েলের দিকে বারবার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আসছে। গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে তারা এসব হামলা চালাচ্ছে বলে দাবি হুতিদের।
এবছর ডিসেম্বরে ইয়েমেনের রাজধানী সানা ও বন্দর শহর হোদেইদাহসহ হুতিদের বেশ কয়েকটি লক্ষ্যস্থলে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর হামলার দুই দিন পরই হুতিরা ফের ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল এবং ইয়েমেনের মধ্যে এমন সংঘাত বাড়ছে।
সিরিয়া সংকট
সম্প্রতি ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের ১২ দিনের ঝড়ো অভিযানের মুখে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। এর মাধ্যমে ২০১১ সাল থেকে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছে সিরিয়ায়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা সিরিয়ার এই সংঘাত শেষে নতুন অন্তর্বতীকালীন সরকার পেয়েছে সিরিয়া। ফিরে পেয়েছে বাক-স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা। দীর্ঘ সময় পর নিজ দেশ, নিজ বাড়িতে ফিরছে সিরিয়ার শরণার্থীরা। আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়ার পরিবর্তিত এই পরিস্থিতি নতুন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ হলেও, মাদক চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য, অন্তঃসারশূন্য সিরিয়ার পরিস্থিতি কতটা সামলে উঠতে পারবেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা।
সিরিয়ার কর্যত শাসক আল-শারা হলেও সম্পূর্ণ সিরিয়া এখন তাদের হাতে নেই। সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল এখন কুর্দি বাহিনীর হাতে। যারা আবার তুরস্কের চোখে সন্ত্রাসী। তুর্কি সরকার এই গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে এই সংঘাত শুধুমাত্র তুরস্কে নয়, ইরাক ও সিরিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে কুর্দি গোষ্ঠী তাদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানাচ্ছে। এর ফলে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি বছরের শুরুতে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরস্কের কুর্দি গোষ্ঠী ডেমোক্রেটিক ইউনিট পার্টি এবং পিপলস ডিফেন্স ইউনিটের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল।
মিশর-ইরান
চলতি বছর মিশর ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের পরিস্থিতি তেমন তীব্র না হলেও আঞ্চলিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু উত্তেজনা বিদ্যমান। মিশর ও ইরান দুটো দেশই মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তি হলেও, তাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে অস্থির ও শত্রুতামূলক।
মিশর একটি সুন্নি মুসলিম দেশ। যেখানে ইসলামের মূল নেতৃত্ব সৌদি আরবের হাতে এবং আঞ্চলিকভাবে সুন্নি ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সাথে তার সম্পর্ক বেশি দৃঢ়। অন্যদিকে, ইরান একটি শিয়া মুসলিম দেশ এবং শিয়া ইসলামকে কেন্দ্র করে তার আঞ্চলিক প্রভাব তৈরি করেছে।
১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে মিশর ও ইরানের সম্পর্কে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কারণ মিশর তখন ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে সমর্থন দেয়নি। ফলে উভয়ের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। চলতি বছর সরাসরি যুদ্ধে না গেলেও, এই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন এখনো তাদের সম্পর্কের মূল চ্যালেঞ্জ।
চলতি বছর সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ বা বড় কোনো কূটনৈতিক বিরোধ না থাকলেও, মিশর ও ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার জন্য শক্তিশালী প্রতিযোগিতা চলছে। উভয় দেশই তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক অংশীদারদের সমর্থন দিচ্ছে।
এদিকে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা মিশরের জন্য উদ্বেগের বিষয়। যদিও মিশর সরাসরি ইরানকে প্রতিরোধ করেনি। তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তারা পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।
এছাড়া, ইরান-সৌদি সম্পর্কের উন্নতি হলেও, মিশর এই পরিস্থিতিতে সরাসরি কোনো ভূমিকা নেয়নি। মিশর এবং ইরান, আঞ্চলিক শক্তির জন্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও, এখন পর্যন্ত সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ বা বড় ধরণের কূটনৈতিক অশান্তি হয়নি, তবে সম্পর্কের উত্তেজনা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলছে।
লিবিয়া
২০১১ সালে গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর থেকেই সংঘাতের মধ্যে রয়েছে লিবিয়া। দেশটিতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ ও আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যে লড়াই চলছে। ফলে দেশটি এখনো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও নিরাপত্তাহীন। গাদ্দাফির শাসন পতনের পর থেকে দুটি প্রধান রাজনৈতিক ব্লকে বিভক্ত লিবিয়া। পশ্চিমে ত্রিপোলিতে অবস্থিত জিএনইউ যা জাতিসংঘের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত এবং পূর্বাঞ্চলে খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ)। এই দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যদিও ২০২১ সালে একটি শান্তিচুক্তি হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। চলতি বছরেও এই দ্বন্দ্বের প্রভাব বিদ্যমান।
এ ছাড়া, লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকায় মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা বিভিন্ন উপজাতি বা রাজনৈতিক দলের সমর্থনে লড়াই করছে। এসব মিলিশিয়া বাহিনী অনেক সময় স্থানীয় জনগণের উপর নির্যাতন চালায় এবং সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে। লিবিয়ার উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিমাঞ্চল এসব গোষ্ঠীর আধিপত্যে রয়েছে, যার ফলে সহিংসতা এবং বাস্তুচ্যুতি বেড়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মিশর, রাশিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ এই দ্বন্দ্বে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লিপ্ত রয়েছে। তুরস্ক পশ্চিমাঞ্চলীয় সরকারকে সমর্থন জানাচ্ছে। অপরদিকে রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত হাফতার এবং তার সমর্থকদের সমর্থন করছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাকে তীব্র করেছে।
দেশটির চলমান প্রেক্ষাপটে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন প্রক্রিয়া। ফলে, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং মানবিক সঙ্কট আরও গভীর হয়ে উঠেছে। যদিও জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবুও এই দ্বন্দ্বের কোনো স্থায়ী সমাধান এখনও দৃশ্যমান নয়।
সুদান (সামরিক বাহিনী ও র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স)
২০২৩ সালে সুদানে সামরিক বাহিনী এবং আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স বা আরএসএফের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়। চলতি বছর এই সংঘাত আরও তীব্র হয়েছে। যা সুদানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
উভয় পক্ষের মধ্যে চলমান যুদ্ধের ফলে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে অগনিত মানুষ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাতের সমাধান করার চেষ্টা করছে। তবুও থামছে না এই গৃহযুদ্ধ।
ফলে সুদানের ভবিষ্যত অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সেই সাথে এই সংঘাতের প্রভাব পড়ছে আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও। গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে দেশটি।
ইথিওপিয়া (তিগ্রে সংঘাত)
২০২০ সালে ইথিওপিয়ার তিগ্রে অঞ্চলে সরকার ও তিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এর সামরিক লড়াইয়ের শেষ হলেও অঞ্চলটি এখনও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে।
২০২২ সালের শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পুনর্গঠন এবং মানবিক সহায়তার বিষয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ এখনও অব্যাহত রয়েছে। সংঘাতের কারণে তিগ্রে অঞ্চলে ব্যাপক মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা এবং মৌলিক প্রয়োজনীয়তার অভাব ছিল। শান্তিচুক্তির পরেও এই সংকট পুরোপুরি সমাধান হয়নি। যদিও সংঘাতের শর্তাবলী অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষ শান্তি বজায় রয়েছে, তবুও কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছর তিগ্রে অঞ্চলে রাজনৈতিক শক্তির পুনর্গঠন ও সেনাবাহিনীর পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে বিতর্ক ও উত্তেজনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, তিগ্রে সংঘাতের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মালি ও পশ্চিম আফ্রিকা
চলতি বছর মালির সরকার ও জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। যা পুরো পশ্চিম আফ্রিকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্স ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাহিনীকে লড়াইয়ের মধ্যে যুক্ত থাকতে হচ্ছে।
২০১১ সালের পর থেকে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে মালি। এই সব সংঘাত বা উত্তেজনা আরও অনেক দেশের মধ্যে চলমান আছে, এবং এই সংঘাতগুলো মানবিক, রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলছে। ২০১২ সালে ইসলামিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির আক্রমণের ফলে গাদ্দাফির পতনের পর দেশটি বিভক্ত হয়ে যায়। এরপর সরকার কার্যকরভাবে দেশের অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
২০২০ ও ২০২১ সালে মালিতে দুটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যার ফলে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। চলতি বছর সামরিক সরকার দেশের পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে এবং রাশিয়ার সমর্থনে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করছে। এই অস্থিরতা দেশটির অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে আরও তীব্র করেছে।
এই সংঘাতের কারণে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং মানবিক সহায়তার জন্য হাহাকার চলছে। চলতি বছর মালি এবং পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোতে শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৫০ লাখ মানুষ খাবারের ঘাটতির শিকার। এছাড়াও, চিকিৎসা সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
মালি সরকার এবং তার মিত্র দেশগুলো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগত সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, এসব অভিযান এখনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। চলতি বছর মালির সামরিক সরকার অস্থিরতা নিরসনে পশ্চিমী শক্তির সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ-এর সমর্থন নেয়, যা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অন্যদিকে, মালি এবং সাহেলীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো যেমন বুরকিনা ফাসো, চাদ এবং নাইজারও একই ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অস্থির করে তুলেছে।
নাইজেরিয়া
নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বোকো হারাম এবং অন্যান্য জিহাদি গোষ্ঠীর সাথে সরকারের সংঘাত চলছে। ২০০৯ সালে নাইজেরিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল বোকো হারাম। তাদের দাবি অনুযায়ী, মূলত ইসলামি শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে তারা। এই গোষ্ঠীটি নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষত বর্নো, ইয়োবে এবং আদামাওয়া রাজ্যগুলিতে সক্রিয়। গোষ্ঠীটি সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ, অপহরণ, আত্মঘাতী বোমা হামলা, এবং সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
চলতি বছর বোকো হারামের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তাদের বিভিন্ন সেল এখনো সক্রিয়। আফ্রিকা ও আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় এই গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে অভিযান চললেও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে বোকো হারামের একটি শাখা গোষ্ঠী হিসেবে ২০১৬ সালে আত্মপ্রকাশ করে ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স বা আইএসডব্লিউপি। তবে তারা এখন বোকো হারামের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
এই সংগঠনটি মূলত ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর আদর্শে পরিচালিত হয়ে পশ্চিম আফ্রিকায় একটি ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। চলতি বছর গোষ্ঠীটির সামরিক তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা নাইজেরিয়ার উত্তরপূর্ব অঞ্চলের পাশাপাশি চাদ, ক্যামেরুন ও নাইজারের কিছু অঞ্চলেও তৎপর।
এই গোষ্ঠীটি বোকো হারামের তুলনায় বেশি সংগঠিত এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেমন ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। তারা নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর সুনির্দিষ্ট আক্রমণ পরিচালনা করছে। ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স শিয়া সম্প্রদায়, সরকার ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি একেবারে হিংস্র মনোভাব পোষণ করে। তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আক্রমণ পরিচালনা করে। ক্রমাগত সন্ত্রাসী হামলার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্য সঙ্কট ও শরণার্থী পরিস্থিতি তীব্র হয়েছে।
কঙ্গো (ডিআরসি), রুয়ান্ডা ও উগান্ডা
চলতি বছর কঙ্গোর (ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো) পূর্বাঞ্চলে মিলিশিয়া গোষ্ঠী এবং পাশের দেশ রুয়ান্ডা এবং উগান্ডার সাথে সহিংসতা চলমান। কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে এম২৩ (মার্চ ২৩) গোষ্ঠী সক্রিয়। কঙ্গো সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তারা।
এদিকে রুয়ান্ডা এই গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। কঙ্গো সরকারের মতে, রুয়ান্ডা তাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে এম২৩ গোষ্ঠীকে সহায়তা করছে। এর ফলে, কঙ্গো এবং রুয়ান্ডার মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে এবং কঙ্গো রুয়ান্ডার বিরুদ্ধে সামরিক এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
অপরদিকে, উগান্ডার ভূমিকা আরও জটিল। আলায়েন্স অফ ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস বা এডিএফ নামে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়। বর্তমানে উগান্ডার মূল ভূখণ্ডে বিরোধী গোষ্ঠী হিসেবে মনে করা হয় তাদেরকে। উগান্ডা নিজে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঙ্গো সরকারের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালালেও, নিজ দেশের মধ্যে উগান্ডার হস্তক্ষেপকে কিছুটা সন্দেহজনক হিসেবেই গ্রহন করে কঙ্গো।
তবে তিনটি দেশের মধ্যে এই সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ। কঙ্গো, রুয়ান্ডা এবং উগান্ডা সবই কঙ্গোর খনিজসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। যা এই সংঘর্ষকে আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী করেছে। রুয়ান্ডা এবং উগান্ডা, একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে এই অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই সংঘাতের কারণে, কঙ্গো, রুয়ান্ডা ও উগান্ডার মধ্যে সহযোগিতা ও শত্রুতা একেবারে নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই তিন দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বছরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, বিশ্বে চলমান যুদ্ধগুলোর পরিণতি এবং তার প্রভাব গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাতের তীব্রতা এখনও কমেনি, বরং তা নতুন মাত্রা নিয়েছে। এসব পরিস্থিতি শুধু নির্দিষ্ট ওই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হয়ে উঠেছে।
এসবি/ওএফ/এমজে