Logo
Logo

আন্তর্জাতিক

২০২৪

এশিয়ার দেশে দেশে যুদ্ধ

শিফা আক্তার বৃষ্টি

শিফা আক্তার বৃষ্টি

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:২৬

এশিয়ার দেশে দেশে যুদ্ধ

বিশ্বজুড়ে নানা পরিবর্তন, উত্তেজনা আর চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলেছে ২০২৪ সাল। এশিয়া মহাদেশের প্রেক্ষাপটে কেমন ছিল এই বছর? এশিয়ার বিভিন্ন অংশে চলছে যুদ্ধ-সংঘাত। বছর ঘুরতেই তা ব্যাপক রূপ লাভ করছে। এই বছর বিশ্বজুড়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর যুদ্ধ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। অনেক আশঙ্কা তৃতীয়বারের বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আমাদের এই পৃথিবী। আর তার শুরু যেন এশিয়া মহাদেশেই। এই আশঙ্কা যে একেবারেই অমূলক না তা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বুঝা যায়।

প্রথম পর্বে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে যুদ্ধ চলছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে থাকছে এশিয়ার দূরপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা।

  • বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান

২০২৪ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল বছর। এই বছরটি ইতিহাসে জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচারের পতনের বছর হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। ১৫ বছরের স্বৈরাচার হটানোর এটি ছিল চূড়ান্ত পর্ব। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ধাপে ধাপে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার উৎখাতের একদফার আন্দোলনে পরিণত হয়।

এ বছরের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। জুলাইয়ে মাঝামাঝি থেকে এই আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর সরকারি বেসরকারি সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

আরও দেখুন >> ২০২৪ : মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা জুড়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

২০ জুলাই শেখ হাসিনা সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সারাদেশে কারফিউ জারি করে। ২৭ জুলাই এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ শুরু করে। সারাদেশে ৬ হাজারের বেশি গ্রেফতার করা হয়। ৫৫০ অধিক মামলা দায়ের করা হয়।

৩ আগস্ট সরকার পতনের একদফায় গোটা দেশ আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ ও বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে শতাধিক শহীদ হন, আহত আন্দোলনকারীর সংখ্যা কয়েক হাজার। আন্দোলন দমনে স্নাইপার রাইফেল ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমাবেশে পুলিশের হামলায় ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতার মৃত্যু এবং কয়েক হাজার আহত হয়। এদিন ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ নামে অবরোধের ঘোষণা করা হয়। ৫ আগস্ট লাখ লাখ মানুষ পুরো ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। গণভবন অভিমুখে মিছিলে মিছিলে সব রাজপথ একাকার হয়ে যায়। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

বাংলাদেশ এ সময় সাংবিধানিক সংকটে পড়ে এবং এর তিন দিন পরে নোবেল বিজয়ী, বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে গঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদ। 

  • মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ

সামরিক ক্যুয়ের মাধ্যমে ২০২১ সালে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে জান্তা বাহিনী। এরপর থেকে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। এ বছর এসে সংঘর্ষ যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ রাখাইন রাজ্যের উত্তর সীমান্ত এলাকা পুরোপুরি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)। মিয়ানমারের তাতমাদো বাহিনী দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। গত ২০ ডিসেম্বর বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের এক-চতুর্থাংশেরও কম ভূখণ্ডের ওপর সেনাবাহিনীর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আছে।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সামরিক ক্যুয়ের পর ২০ হাজারের বেশি জনকে আটক করেছে জান্তা সরকার। সেইসঙ্গে হাজার হাজার ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

  • মিয়ানমার-চীন উত্তেজনা

আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে সম্পর্ককে বলা হয় ‘পাউক-ফাও’ বা ‘ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক।’ কিন্তু বাস্তবে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের নয়। এ সম্পর্ক আসলে এক অস্বস্তিকর সহাবস্থান। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি চীনের সমর্থন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণের কারণে মিয়ানমারে চীনবিরোধী মনোভাব রয়েছে প্রবলভাবে। অপরদিকে চীনের আচরণে মিয়ামারের প্রতি শত্রুতা না দেখা গেলেও হৃদ্যতার সম্পর্কও নেই। মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে ২ হাজার ২২৭ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। সুতরাং নিজ স্বার্থেই মিয়ামারের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও সম্পর্ক ভালো রাখতে চীনের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। এমনকি বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতেও অনেকটাই নিশ্চুপ চীন। রাজনীতি, কূটনীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই চীনের উন্নতি এবং নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার প্রচেষ্টা বিশ্ববাসীর নিকট স্পষ্ট।  স্পষ্ট মিয়ানমারের কাছেও।

সম্প্রতি সীমান্তে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি ও জান্তাবাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ে বারবার মিয়ানমারকে সতর্ক করতে দেখা গেছে চীনকে। পাশাপাশি অব্যাহত রয়েছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ। চীনের চাপ ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বাইরেও প্রসারিত। তারা কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মিকে জান্তার সঙ্গে লড়াই বন্ধ করার এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে চাপ দেওয়ার জন্য তাদের সীমান্ত চেকপয়েন্টগুলো বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। 

দুটি স্পষ্ট উপায়ে সামরিক জান্তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে চীন। প্রথমত, সামরিক সাহায্য। অনেকেই মনে করেন, চীনের দেওয়া বিমানশক্তি না থাকলে জান্তা অনেক আগেই পরাজিত হয়ে যেত। বিষয়টি বুঝেই চীন সম্প্রতি আরও ছয়টি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে। শান, রাখাইন, কাচিন ও কায়াহ রাজ্য এবং সাগাইং অঞ্চলে বেসামরিক জনগণের ওপর জান্তার বিমান হামলা বাড়াতে ঠিক সময়ে পৌঁছেছিল বিমানগুলো। 

দ্বিতীয়ত, জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ করার জন্য জাতিগত প্রতিরোধ শক্তিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে চীন। সংক্ষেপে মিয়ানমারের বর্তমান ঘটনাবলিতে চীনের ভূমিকাকে মিয়ানমারের জনগণের হাত থেকে সামরিক জান্তাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। আর এর উদ্দেশ্য একটাই, চীনের নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। 

মিয়ানমারের সীমান্তে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা বিভিন্ন সংঘাতের কারণে নিজেদের সীমান্তে বা দেশের অভ্যন্তরে যেন কোনো সমস্য সৃষ্টি না হয় তাই সম্প্রতি চীন মিয়ানমারকে বারবার সতর্ক করছে। চীন তার দক্ষিণ সীমান্তে সক্রিয় রয়েছে। তার সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের এলাকায় শক্তিধর বিদ্রোহী শান জাতিগোষ্ঠী এবং জান্তা সরকারকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করেছে তারা। চীনের এই মধ্যস্থতায় সামরিক শাসক বা বিদ্রোহী শান গোষ্ঠীর কেউই খুশি নয়। এর কারণ, তারা ভালো করেই জানে, চীনের মূল লক্ষ্য এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়। চীনের মূল লক্ষ্য, খনিসমৃদ্ধ এই এলাকায় তার বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত স্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিজেদের সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী চীন, মিয়ানমারের সাথে সম্মুখ সমরে না গেলেও দুই দেশের মধ্যে চাপা উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

  • টালমাটাল পাকিস্তান

২০২৪ সালজুড়ে পাকিস্তানেও নানা অস্থিরতা চলছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানের মুক্তি নিয়ে বছরজুড়ে আন্দোলন করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এই নভেম্বরে বিক্ষোভে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া দেশটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। 

পাকিস্তান এসব হামলার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) দায়ী করে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। এতে অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে আরও অনেকে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে আফগানিস্তান।

টিটিপিকে লক্ষ্য করে হামলা করা হয়েছে বললেও আফগানিস্তান বলছে, বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এর পাল্টা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ার বার্তা দিয়েছে আফগানিস্তান। তাই বছর শেষ হওয়ার আগে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মির নিয়ে উত্তেজনা তো আছেই।

  • আফগানিস্তান সংকট

চলতি বছর আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং তালেবান এর মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তান দখল করার পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে একটি ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেছে তালেবান। তবে, ইসলামী স্টেট (আইএস)-এর আফগান শাখা আইএস-কুরাসান, তালেবানের প্রতি তাদের বিরোধিতা বজায় রেখে আফগানিস্তানে ক্রমাগত সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আইএস-খুরাসান তাদের ক্ষমতা হুমকির মধ্যে ফেলেছে। আইএস-খুরাসান তালেবানকে ‘অসুন্নি’ এবং ‘আল-কায়েদার বিরুদ্ধে’ বলে আক্রমণ করে। যা তাদের মধ্যে শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, আইএস তালেবানকে তাদের আদর্শের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে দুই গোষ্ঠী একে অপরকে আক্রমণ করে আসছে।

চলতি বছর আইএস-খুরাসান আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে। বিশেষত রাজধানী কাবুলসহ অন্যান্য শহরে আত্মঘাতী হামলা ও বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। তালেবানও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে, তবে আইএসের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুপক্ষের এই দ্বন্দ্বের মধ্যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানকে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু তালেবান আইএস-খুরাসানকে দমন করতে সক্ষম হচ্ছে না। আইএস-খুরাসান আফগানিস্তানকে তাদের কার্যক্রমের একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করছে। আফগান জনগণকে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলছে।

এছাড়াও পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত সংঘাত দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার অন্যতম কারণ। ১৯৪৯ সাল থেকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে সশস্ত্র সংঘর্ষ ও গোলাগুলির একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ এই ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। ফলে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এই হামলায় শতাধিক মানুষ মারা যায়।

পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের জন্য বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তানে আফগান জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কাবুলের কাছে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ আফগান সরকারকে টিটিপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন।

এসময় তিনি বলেছিলেন, আফগান মাটি থেকে পাকিস্তানে হামলা পরমাণু অস্ত্রধারী এই দেশটির জন্য একটি “রেড লাইন”। তিনি আরও বলেন, এই ইস্যুতে কাবুলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইসলামাবাদ, কিন্তু সংলাপ এবং হামলা “একসাথে চলতে পারে না”।

আফগান তালেবানরা তাদের দেশে অবস্থানরত টিটিপি সন্ত্রাসীদের ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে আসছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

  • মিয়ানমার-বাংলাদেশ

২০১৭ সালের শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হয়। অভ্যন্তরীণ নানা প্রতিকূলতা স্বত্বেও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা সংকট এখন বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে আটকে আছে। 

সেই সাথে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্কও তলানিতে ঠেকেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসন ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে মিয়ানমারের পাশাপাশি বারংবার আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েও কোনো ফলাফল পায়নি বাংলাদেশ।

সর্বশেষ বাংলাদেশের জনগণ ও স্থাপনা লক্ষ্য করে টেকনাফ সীমান্তে গুলি ছুঁড়েছে মিয়ানমার। এর আগে গত ৯ অক্টোবর কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের মৌলভীরশীল সংলগ্ন সাগরে বাংলাদেশি মাছ ধরার কয়েকটি ট্রলার লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে মিয়ানমারের নৌবাহিনী। এসময় এক জেলে নিহত ও আহত হয়েছেন আরও তিন জেলে। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই টেকনাফ সীমান্তে গুলির ঘটনা ঘটে।

তবে এই ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও টেকনাফ সীমান্ত লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে মিয়ানমার। চলতি বছরের ১৮ জুন জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৬তম অধিবেশনে, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর অনুষ্ঠিত একটি সংলাপে এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন জেনেভাস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের ভারপ্রাপ্ত স্থায়ী প্রতিনিধি মিজ সঞ্চিতা হক। কিন্তু কোনো ফল হয়নি তাতে।

এর আগে ২০০৮ সালে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলসীমায় বিতর্কিত গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে উত্তেজনা বাড়ার এক পর্যায়ে, বাংলাদেশ ও তৎকালীন বার্মার মুখোমুখি অবস্থানের ঘটনা ঘটে। তারপর কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের এক পর্যায়ে ৯ দিন পর নিজেদের জাহাজ সরিয়ে নেয় বার্মা। সেসময়ের উত্তেজনা খানিকটা প্রশমিত হলেও পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তা বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে।

আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে মিয়ানমারের সেনাসদস্য থেকে শুরু করে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য ও বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। এই সংখ্যা এরই মধ্যে ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েও এদের দেশে ফেরত পাঠাতে পারেনি। 

তবে দুই দেশের মধ্যে চলতে থাকা এই চাপা উত্তেজনা আপাতত কোন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রূপ নেবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে দ্রুত রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এ নিয়ে বিশৃংঙ্খলাসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি হবে বলেই মনে করছেন তারা।

মিয়ানমার-ভারত

মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর যে সংঘর্ষ চলছে তাতে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সেনা ও নাগরিকদের কারণে উদ্বিগ্ন ভারত। বাংলাদেশের মতো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আগ্রহী না তারা। 

মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ) এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সসহ অন্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সমন্বিত আক্রমণের মুখে জান্তা সরকারের সেনারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিয়েছেন। সর্বশেষ ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের একাংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় আরকার আর্মি। এ পর্যন্ত বিদ্রোহী যোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাঁচ শতাধিকেরও বেশি সেনাসদস্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেনাদের অভিযানের মুখে মিজোরামে অন্তত ৪৫ হাজার চিন জাতিগোষ্ঠীর শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন।

এদিকে ভারত সরকার মিয়ানমারের সীমান্ত লাগোয়া পূর্বাঞ্চলীয় এক হাজার ৬৪০ কিলোমিটার এলাকার অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। মিজোরামের সীমান্ত এলাকা জোখাওথার ও মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা তিয়াও নদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত সাদা-লাল রঙের সেতুর কাছে কিছুদিন আগেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্বরত ছিল। কিন্তু এখন মিয়ানমারের ওই অঞ্চলের সর্বত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের পতাকা উড়ছে। মিজোরাম ও জোখাওথারের সংযোগ সেতুর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর হাতে রয়েছে। 

মিয়ানমারের চিন রাজ্য এবং সাগাইং রাজ্যের বেশির ভাগ এলাকা ভারতের মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত। আর এই পুরো অঞ্চল এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে চলে গেছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ভাষায় ওই অঞ্চল এখন ‘স্বাধীন এলাকা’। 

বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিএনএফ ইতোমধ্যে সেখানে স্বায়ত্তশাসিত ‘চিনল্যান্ড কাউন্সিল’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। দিল্লি ও মণিপুরকে এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হতে বলে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দিয়ে মাদক, অস্ত্র ও অন্য কোনো কিছু পাচার করতে দেওয়া হবে না। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও তারা হস্তক্ষেপ করবে না বলে তারা দিল্লিকে আশ্বস্ত করেছে। 

ভারতের চিন্তা বাড়িয়ে মিজোরামের অপর প্রান্তে পালাতোয়া শহরটি এখন আরেকটি জাতিগত সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মির দখলে। এই পালাতোয়া শহরটি ভারতের উচ্চাভিলাষী ‘কালাদান মাল্টি মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত রাখাইন রাজ্যের সিত্তি বন্দরের সঙ্গে কলকাতার সংযোগ স্থাপন করতে চায়। এই পালাতোয়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালাদান নদীর ওপর নির্মিত সেতুর মাধ্যমে মিজোরামের সঙ্গে শহরটির সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করার কথা। 

বছরের শুরুতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি এই অঞ্চলে সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম (এফএমআর) বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অমিত শাহের এই ঘোষণার তীব্র সমালোচনা এসেছে। অনেকেই বলছেন, ব্রিটিশ সরকার ভাইয়ে ভাইয়ে বিভক্তি ও হানাহানি বাধিয়ে দেওয়ার জন্য সীমান্ত টেনেছিল। সেই সীমান্ত এখনো উন্মুক্ত থাকার কারণে উভয় পারের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মধ্যে আত্মীয়তা রয়েছে। কিন্তু সেখানে সীমানাদেয়াল বা প্রাচীর তৈরি করলে সেই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বন্ধন একেবারে ছিন্ন হয়ে যাবে। 

রাখাইনের রাজধানী সিতওয়েতে ভারতের তৈরি করা গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলও আক্রমণের মুখে রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এককথায় শিলিগুড়ি করিডরের বিকল্প হিসেবে ভারত যে কালাদান প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তা এখন চীন–সমর্থিত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে পড়তে যাচ্ছে। এর ফলে উত্তর রাখাইনে ভারত-চীনের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নতুন রূপ নিতে পারে। 

ভারতের সঙ্গে রাখাইনের প্রধান শক্তি আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক অঙ্গ ইউনাইটেড আরাকান লিগের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে তিক্ত। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের বিভিন্ন সংস্থা আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তেমন সফল হয়নি বলে নানা সূত্রে জানা গেছে। এটা এখন পরিষ্কার যে রাখাইন পরিস্থিতির ওপর একদিকে এ অঞ্চলে মিয়ানমার-ভারত উত্তেজনার নিরসন, চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। 

  • চীন-ভারত

চীন ও ভারতের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সীমান্ত রয়েছে। ফলে রয়েছে সীমান্ত সংঘাতও। ১৯৬২ সালে সীমান্ত যুদ্ধের পর গত পাঁচ দশকে উভয় দেশের মধ্যে ছোটখাট বিভিন্ন সংঘাত লেগে রয়েছে। গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষ চীন-ভারত সম্পর্কে নিঃসন্দেহে একটি টার্নিং পয়েন্ট। যে কারণে এখনও উভয় দেশ গালওয়ান সংষর্ঘ-পূর্ববর্তী অবস্থায় নিজেদের সম্পর্ক উন্নীত করতে পারেনি।

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব সীমান্ত সমস্যার বাইরেও বিস্তৃত। এমনকি সীমান্ত সমস্যার সমাধান হলেও হয়তো উত্তেজনা কিছুটা কমবে, কিন্তু সংকট সম্পূর্ণভাবে দূর হবে না। সীমান্তের বাইরে অন্য বিষয়গুলো তখন সামনে আসবে, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। 

চীনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি এই চার দেশের সম্মিলিত জোট কোয়াডও তৈরি হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক বা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় ভারত তার কোয়াড সদস্যদের নিয়ে পরিকল্পনা করছে। ভারত তার তিনটি কোয়াড অংশীদারকে অন্তর্ভুক্ত করতে মালাবার নৌ অনুশীলনের পরিধি প্রসারিত করেছে।

দীর্ঘ দিন ধরে ভারত-চীন উত্তেজনা বিরাজ করলেও ২০২৪ সালে বরফ গলতে শুরু করেছে। বিতর্কিত অঞ্চল থেকে উভয় দেশই তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করছে। তবে এশিয়ার দুই মহাশক্তিধর দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে বড় বাধা পারস্পরিক অনাস্থা।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়ন জয়শঙ্কর চলতি মাসে সংসদে বলেছেন, সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ‘খানিকটা উন্নতির দিকে গেছে’। তবে, তিনি সীমান্তে স্থিতিশীলতা ফেরানোর উপর বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলছি, আমাদের সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে পূর্ব-শর্ত হলো সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখা।

বিতর্কিত অঞ্চলে উভয় দেশের সৈন্যরা মুখোমুখি সংঘাত থেকে পিছু হটলেও হাজার হাজার সৈন্য এই শীতে পঞ্চমবারের মতো এখনো হিমালয়ে রয়েছে। সীমান্ত বরাবর কামান ও যুদ্ধবিমান এখনো মোতায়েন রাখা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দুর্বলভাবে চিহ্নিত ও নির্ধারিত ৩ হাজার ৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত অঞ্চল নিয়েই বিবাদ ও বিতর্ক। ২০২০ সালে সীমান্তে খণ্ডযুদ্ধের পর অস্থিরতা ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। উল্লেখ্য, ওই সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় ও চারজন চীনা সেনা নিহত হয়েছিল।

পাঁচ বছর পর সীমান্ত বিতর্ক নিয়ে উচ্চ-পর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনা পুনরায় শুরু হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে বেইজিংয়ে বৈঠক হওয়ার পর উভয় পক্ষই সুনিশ্চিত করেছে যে, তারা সমাধান সূত্র খুঁজতে দায়বদ্ধ- যে সমাধান ন্যায্য, যৌক্তিক ও উভয়পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য। 

অক্টোবরে রাশিয়ায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠকের পরপরই সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অর্থনৈতিক সমন্বয়ের চাকা এবার দ্রুত গড়াবে। চীনের নজর ভারতের ক্রমবর্ধমান বাজারের দিকে। নয়াদিল্লিও চীন থেকে পণ্য আমদানি করতে আগ্রহী, কারণ ভারত উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠতে চাইছে। সীমান্ত সংকট সত্ত্বেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিকাশ লাভ করেছে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের সংঘর্ষের পরিণতিতে চীনের বিনিয়োগ ও ভিসা দেওয়ার উপর কড়াকড়ি চাপিয়েছিল ভারত।

১৯৬২ প্রথম ভারত-চীন যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সীমানা নিয়ে বিরোধ থেকে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। এরপর থেকে ওই সীমান্ত অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকে। বিভিন্ন সময় উত্তেজনা বিরাজ করলেও সর্বশেষ দুই দেশ পরস্পর সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে সম্মত হয়েছে।

  • ভারত-পাকিস্তান

ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক বিশেষত কাশ্মীর নিয়ে এখনও উত্তপ্ত। দুই দেশের মধ্যে সীমানা বিরোধ এবং সামরিক সংঘর্ষ প্রায়ই ঘটছে। যদিও মাঝে মাঝে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়, কিন্তু পরিস্থিতি অনেকটা অস্থিরই থাকে। 

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই বেশ কয়েকটি বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান ছিল। কাশ্মীর সমস্যা দেশ দুটির মধ্যে বিরাজমান প্রধান সমস্যা। দুই দেশের এই যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বেশ কয়েকটি উগ্রবাদী সংগঠন তৈরি হয় । যদিও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় থেকেই আন্তঃরাজ্য বিরোধ রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে অন্তত তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। এছাড়াও, ১৯৮৪ সালের পর থেকে সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই দেশ বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে জড়িত হয়েছিল।

ভারত সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটি তাদের বলে দাবি করে। যার মধ্যে ২০১০ সালের হিসাবে জম্মু বেশিরভাগ অংশ, কাশ্মীর উপত্যকা, লাদাখ ও সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে প্রায় ৪৩ শতাংশ অঞ্চল শাসন করছে। পাকিস্তান এই দাবির বিরোধিতা করে, যারা প্রায় কাশ্মীরের ৩৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে আছে আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট বাল্টিস্থানের উত্তরাঞ্চল। আর বাকি অংশ চীনের দখলে।

  • চীন-তাইওয়ান

‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতির আওতায় তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে চীন। কিন্তু তাইওয়ান তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায়। এই দ্বন্দ্বে আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো চীনের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। ফলে এই অঞ্চলে উত্তেজনা অনেক বেড়েছে।

স্বায়ত্বশাসিত তাইওয়ানকে নিজের বলে দাবি করে চীন। অঞ্চলটিকে নিজ ভূখণ্ডের সঙ্গে একীকরণের লক্ষ্য অর্জনে শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি। দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই তাইওয়ানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির বিরোধিতা করে আসছে। উত্তেজনার মধ্যেই গত ৩০ নভেম্বর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যান।

এই সফরের নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানে সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী ও পৃষ্ঠপোষক। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাইওয়ান ইস্যুটি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করা। দ্ব্যর্থহীনভাবে তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা এবং চীনের শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণকে সমর্থন করা।

তাইওয়ান ঘিরে কিছু দিন পরপরই চীনের সামরিক মহড়া চলে। চীনের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এসব মহড়ায় অংশ নিয়ে থাকে। চীনের দাবি, স্বাধীনতার নামে তাইওয়ানে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ কর্যকলাপ চলছে। তাই তাইওয়ানকে ‘শাস্তি’ দেয়ার জন্যই সেনা মহড়া চালানো হচ্ছে। ক্ষমতা দখল করে নেওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দক্ষতার বিষয়টি মহড়ায় দেখা হচ্ছে।

  • কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা

১৯৫০ সালের কোরিয়া যুদ্ধ ২০২৪ এসেও যেন শেষ হয়নি। দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দুই দেশই যেন সবচেয়ে বড় বাধা। এ বছরও উভয় দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের আত্মসমর্পণের পর ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর কোরিয়ান উপদ্বীপকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানি বাহিনীর অপসারণের তদারকির জন্য ৩৮ ডিগ্রি রেখা কোরিয়াকে ভাগ করে। এর ফলে ১৯৪৮ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়।

১৯৫০ সালে কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘের বাহিনী হস্তক্ষেপ না করা পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে পরাজিত করে। ১৯৫০-১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধের পরে ধ্বংসপ্রায় দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৯০ সালে এসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিগুলির একটিতে পরিণত হয় এবং সেই সঙ্গে এশিয়ান চার ড্রাগনয়ে পরিণত হয়। 

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। উত্তর কোরিয়া তার সামরিক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য চেষ্টায় রয়েছে, যা এশিয়া এবং বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।

এসবি/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর