ইসরায়েলকে পরাজিত করে বিশ্বকে যে বার্তা দিল হামাস
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯:৩৯
![ইসরায়েলকে পরাজিত করে বিশ্বকে যে বার্তা দিল হামাস](https://www.bangladesherkhabor.net/uploads/news_photos/2025/01/17/bangldesher_khabor-BD-678a5da8cf31a.jpg)
টানা ১৫ মাস ধরে নৃশংস হামলা ও নজিরবিহীন গণহত্যার চালানোর পর দখলদার ইসরায়েল কোনো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না করেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। গণহত্যার বৈধতা দেওয়ার জন্য শুরুতে তাদের ঘোষিত লক্ষ্যগুলো ছিল— হামাসকে ধ্বংস করা, গাজায় ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্ত করা ও ইহুদিবাদী বসতি স্থাপনকারীদের নিরাপদে গাজার সীমানায় বসতি স্থাপন করা। কিন্তু কোনো লক্ষ্যই তারা অর্জন করতে পারেনি। এই চুক্তি কোনো সুযোগ বা বাধ্য হয়ে করেনি হামাস; বরং এটা গাজাবাসী অটল থাকার ফলাফল। চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে ধৈর্য ও জোর করে একটি নতুন বাস্তবতা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে নতি স্বীকার না করার দলিল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার কুখ্যাত সঙ্গীরা সারা বিশ্বের সামনে গাজার বাসিন্দাদের হত্যার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে। গাজায় সবচেয়ে উন্নত প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করার হুমকিও দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ আরব ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবসহ অন্যান্য অনেক দেশ গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যাকে স্পষ্টভাবে সমর্থন করেছিল।
এত কিছুর পরও নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্ত করতে পারেনি। গণহত্যার ৫৪ দিন পর, ফিলিস্তিনিদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে মাত্র ১০ জনকে মুক্ত করেছিলেন। সেটাও হামাসের চাওয়াতেই তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে কমপক্ষে ৪৬ হাজার ৭০৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও এক লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জন আহত হয়েছেন। গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল ও শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধের মুখে গাজাবাসী অসাধারণ ধৈর্য প্রদর্শন করেছেন। ১৫ মাসের নিরলস বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞেও গাজাবাসী চেতনায় ফাটল ধরেনি। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের মুখেও তারা নতি স্বীকার করেনি। তারই ফলাফল এই স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি। ইসরায়েল কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করতে পারেনি। গাজা যুদ্ধ তাদের এক কঠিন বাস্তবতার মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ।
গণহত্যার ‘লাইভস্ট্রিম’ চলার ৪৬৭ দিনের মাথায় নেতানিয়াহু হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য হন। ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তির নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য হামাসের সাথে চুক্তিতে সম্মত হন। চুক্তির বিষয়গুলো দেখলে বুঝা যায় যে হামাসের দ্বারা দেওয়া প্রায় সব দাবি পূরণ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায়, নেতানিয়াহুর একটি দাবিও পূরণ করা হয়নি। এই চুক্তি ইসরায়েলের পরাজয়ের দলিল। জায়নিস্টদের স্পষ্ট পরাজয়ের বার্তা দেয় এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় নেতানিয়াহু হামাসকে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে টিকে থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত হামাসের সাথেই চুক্তি করতে হলো। এমনকি হামাসের ঘোষণা দেওয়ার আগের ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেতানিয়াহুর অফিসকে জানায়, তারা হামাসের জবাবের অপেক্ষায় আছে। ইসরায়েলের গণহত্যার সহযোগীরা ছাড়াও সমস্ত ইসরায়েলিরা হামাসের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় ছিল। তাদের সব ধরনের শক্তি ও ক্ষমতা হামাসকে আত্মসমর্পণ ও পিছু হটতে বাধ্য করতে পারেনি।
ইতোমধ্যে তার মন্ত্রিসভার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়কমন্ত্রী বেন গাভির স্বীকার করেছেন যে ইসরায়েল যুদ্ধে হেরেছে। তিনি বলেছেন, ‘গাজার উদযাপনের দৃশ্য দেখে আমরা বুঝতে পারছি কোন দল আত্মসমর্পণ করেছে। যদি ইসরায়েল এই চুক্তির অনুমোদন দেয়, তাহলে আমি সরকার থেকে পদত্যাগ করব!’
নেতানিয়াহু এই গণহত্যার মাধ্যমে ইসরায়েলকে সমগ্র বিশ্ব থেকে ‘একঘরে’ করে ফেলেছেন। ইসরায়েলকে এখন অপরাধী ও অনৈতিক ব্যক্তিদের দেশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। গাজায় নেতানিয়াহুর গণহত্যা মার্কিন ও পশ্চিমা জনগণের চোখ খুলে দিয়েছে। যারা স্বীকার এখন বুঝতে পারছেন যে জায়োনিস্টরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কতটা নিচে নামতে পারে, কতটা নৃশংস হতে পারে।
ইয়াহইয়া সিনওয়ার এক বক্তৃতায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ইসরাইল একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। মনে হচ্ছে গাজায় নেতানিয়াহুর যুদ্ধাপরাধ সিনওয়ারের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্যে রূপ দিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পরোয়ানা জারি করেছে। এমনকি পশ্চিমের মতো দেশগুলোতে ইসরায়েলি সেনারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আইনের হাত থেকে বাঁচতে।
মৃতের সংখ্যা, আহত ও বৃহৎ পরিসরে ধ্বংসযজ্ঞ যাই হোক না কেন, হামাস যে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে তা প্রমাণ করার জন্য আর কী দরকার? ক্ষতি দিয়ে বিজয় মাপা হয় না, মাপা হয় কোন পক্ষ অপরের শর্ত মেনে নেয়। এই চুক্তির মাধ্যমে নেতানিয়াহু হামাসের শর্ত মেনে নিয়ে পরাজয় বরণ করেছেন। যে বিষয়টি নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল তা হলো গাজায় ফিলিস্তিনিদের অলৌকিক প্রতিরোধ। গাজা অভিযানে থাকা ইসরায়েলি সৈন্যরা বেশ কয়েকবার বলেছেন যে তারা গাজায় ভূতের সাথে যুদ্ধ করছে।
নেতানিয়াহু কি চুক্তির শর্ত মানবেন? ইহুদিবাদীরা সাধারণত প্রতিটি চুক্তি লঙ্ঘন করতে অভ্যস্ত। আর মার্কিনিরা চুক্তির গ্যারান্টার হওয়া মানে চুক্তি ভঙ্গ সম্ভবনা অধিক। তবে তারা যদি যুদ্ধে ফিরে আসে, তাহলে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত ফিলিস্তিন।
বিশাল চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গাজাবাসী তাদের অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে অটল ছিলেন। ইসরাইল পশ্চিমের সমস্ত সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে এই লোকদের দমন করতে পারেনি। তারা শহীদ হয়েছেন, তারা মারা গেছেন, কিন্তু তারা কখনও হাল ছাড়েননি। ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ সমগ্র পশ্চিমা দেশগুলো মুষ্টিমেয় সাহসী লোকদের হারাতে পারেনি। তারা নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে। তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। তারা বর্বরতা চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আর গোটা বিশ্ববাসীর ঘৃণা অর্জন করেছে। সামরিকভাবে তাদের অর্জন শূন্য।
বিশ্ববাসী ইসরায়েলে এই নৃশংসতা মনে রাখবে আজীবন। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লাঠি হাতে লড়ে যাওয়া ইয়াহইয়া সিনওয়ারের কথা মনে রাখবে। বিশ্ববাসী ইসমাইল হানিয়ার সেই হাসিমাখা মুখ মনে রাখবে, যখন তিনি শুনতে পেলেন তার পরিবারের অধিকাংশ মানুষ ইসরায়েলি হামলায় শহীদ হয়েছেন। আজ হামাস মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র ফিলিস্তিনিরা।