-67cd954d2a217.jpg)
মাওলানা আমির খসরু। বিগত প্রায় ৬ বছর ধরে কানাডার ক্যালগারীতে অবস্থিত গ্রিন ডোম মসজিদে ইমামতি করছেন। ইমাম হওয়ার সুবাদে সেখানকার মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে তার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। দেশটির মুসলিমদের জীবনযাপন, তাদের অতীত, বর্তমান নিয়ে তার ভালো জানাশোনা এবং বর্তমানের আয়নায় কানাডায় বসবাসরত মুসলিমদের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে এবং সর্বোপরি নায়াগ্রার এই দেশটিতে কেমন আছেন তারা- এসব নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেলায়েত হুসাইন।
বাংলাদেশের খবর : দীর্ঘ দিন ধরে কানাডায় আছেন। কীভাবে এখানে এলেন এবং বর্তমানে কী কী কাজ করছেন?
মাওলানা আমির খসরু : আমি একটি মসজিদের ইমাম ও খতিব এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছি এবং পাশাপাশি রাতের বেলা একটা কোম্পানিতে ১২ ঘণ্টা কাজ করি। কাজের কথাটি বলার একটাই কারণ, আর তা হলো, আমাদের দেশের বেশিরভাগ ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা অন্য কাজে লজ্জা পান। যার কারণে আর্থিকভাবে তারা পিছিয়ে থাকেন। তাদের উদ্বুদ্ধ করাই উদ্দেশ্য। আর আমি কানাডায় আসি ২০১৯ সালে। আমার মেজ ভাই নূর মোহাম্মাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা সপরিবারে কানাডা আসার সুযোগ পাই। এবং তার দীর্ঘ ১০ বছরের আপ্রাণ চেষ্টার ফলে আমি এখন কানাডার নাগরিক এবং এখানে ইসলামের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
বাংলাদেশের খবর : বাংলাদেশি আলেমরা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেতে চান এবং যান, কিন্তু আপনি কেন পশ্চিমের এই দেশটিকে বেছে নিলেন। অথচ এখানে ইসলামি জীবনযাপন কিছুটা কঠিন মনে হয়!
মাওলানা আমির খসরু : বাংলাদেশি আলেমরা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার প্রবণতা রাখেন, যেখানে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সুযোগ ও আর্থিক সুবিধা বেশি। তবে কিছু আলেম পশ্চিমা দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, এর পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে-
১. কমিউনিটি সেবা ও সুযোগ: পশ্চিমা দেশে মুসলিম কমিউনিটির সেবা করার সুযোগ বেশি হতে পারে, যেখানে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও শিক্ষার প্রচার করা যায়।
২. শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ: পশ্চিমা দেশে ইসলামিক স্কলারশিপ ও গবেষণার সুযোগ বেশি, যা ব্যক্তিগত ও পেশাগত বিকাশে সহায়ক হতে পারে।
৩. বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব: পশ্চিমা দেশে অবস্থান করে বৈশ্বিক ইসলামি ইস্যুতে প্রভাব ফেলতে ও অংশগ্রহণ করতে সুবিধা হতে পারে।
এ ছাড়া, কিছু আলেম আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে ও পরিবারের জন্য ভালো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পশ্চিমা দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোর ভিসা পাওয়া অনেক কঠিন। তবে, ইসলামি জীবনযাপন ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, অনেক আলেম এই সিদ্ধান্তকে ধর্মীয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখেন। আমার মনে হয়, সেজন্যই তারা এসব দেশে আসেন।
বাংলাদেশের খবর : বাংলাদেশের অনেকে মানুষ কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে চান। সেক্ষেত্রে বিশেষত, কানাডা ইসলামপ্রিয় মানুষের জন্য কতটা উপযুক্ত?
মাওলানা আমির খসরু : কানাডা একটি বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় দেশ, যেখানে মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কানাডার বিভিন্ন শহরে মসজিদ, ইসলামিক স্কুল এবং মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত মসজিদের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে ইসলামিক জীবনযাপনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেমন—
১. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য: পশ্চিমা সমাজের মূল্যবোধ ও প্রথার সঙ্গে মানিয়ে চলা কিছুটা কঠিন হতে পারে।
২. মসজিদের সংখ্যা কম: যার ফলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সবাই মসজিদে গিয়ে আদায় করতে পারেন না, আবার অনেক সময় যেতে চাইলেও কর্মবস্ততার কারণে যেতে পারেন না। তবে কানাডার সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মান অনেক উচ্চস্তরের, যা অভিবাসীদের জন্য আকর্ষণীয়।
বাংলাদেশের খবর : আপনার অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলেন, তাহলে এখানকার মুসলিম ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন এবং বাংলাদেশি মুসলিমদের অবস্থানটা কোথায়?
মাওলানা আমির খসরু : কানাডায় মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সাধারণত সহনশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশি মুসলিমরা এখানে একটি উল্লেখযোগ্য কমিউনিটি গঠন করেছেন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয়।
বাংলাদেশের খবর : কানাডায় ইসলামফোবিয়া আছে কি? ইসলামি পোশাকের কারণে আপনি কি কখনো প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন?
মাওলানা আমির খসরু : কানাডায় ইসলামফোবিয়া বা মুসলিম-বিরোধী মনোভাব কিছু আছে, নেই বললে ভুল হবে। তবে এটি তুলনামূলকভাবে কম। কানাডার সমাজ সাধারণত বহুজাতিক ও বহুধর্মীয়, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। তবে কিছু মুসলিম নাগরিককে তাদের ধর্মীয় পোশাকের কারণে নেতিবাচক মনোভাব বা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। যদিও এখন পর্যন্ত আমার সাথে এমন আপত্তিকর কিছু ঘটেনি। তবে আমি যখন টুপি ও জু্ব্বা পরে বাইরে যাই এবং বিশেষ করে সাথে যখন কালো বোরকা পরা আমার স্ত্রী, আমার ৪ বছরের মেয়েকে হিজাব পরিধানসহ ওরা দেখে, তখন আশেপাশের লোকজন এমনভাবে দেখে যে তারা এমনটা প্রথমবার দেখলো! তবে সুখবর হলো- কানাডায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গেলো ১০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, যেখানে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম কমিউনিটিগুলো তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি রক্ষার পাশাপাশি সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
বাংলাদেশের খবর : কানাডায় মুসলিমদের ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন আপনি?
মাওলানা আমির খসরু : কানাডায় মুসলিমদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করি। কমিউনিটি শক্তিশালী হচ্ছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষিত রয়েছে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কানাডায় মুসলিম কমিউনিটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক ধারণা করা যায়। দেশটির বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় সমাজে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ, যেমন— ইসলামফোবিয়া ও সামাজিক সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান, তবুও সরকারের নীতিমালা ও সমাজের সমর্থনে মুসলিম কমিউনিটি তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ ও সংহত কমিউনিটি গঠন সম্ভব।
বিএইচ/