Logo

জীবনানন্দ

স্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রিয় কবি মাস্টার ইউনুস আলি মিয়া

বেলায়েত হুসাইন

বেলায়েত হুসাইন

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১৩:৫৬

স্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রিয় কবি মাস্টার ইউনুস আলি মিয়া

পাড়ার লোকদের শিরোনামহীন এক বৈঠকে একটি মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছতেই সবার চেহারা কেমনযেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দিনটি ছিল ২০২০ সালের ৮ মে শুক্রবার। এদিন ভোররাতে ইউনিয়নের একজন গুণী মানুষকে হারিয়ে শোকাহত এলাকাবাসী। তিনি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলাধীন দাদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাস্টার মুহাম্মাদ ইউনুস আলি মিয়া (৬০)। দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগে তিনি মারা যান। বরেণ্য একজন মানুষের বিদায়েই স্থানীয় মানুষের এই শোক। 

কোন্দারদিয়া গ্রামের ইউনুস আলি মিয়া দাদপুর ইউনিয়নের রাঙ্গামুলারকান্দির উচ্চবিদ্যালয় হাজি আব্দুল্লাহ একাডেমির সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকায় স্থানীয় লোকজন তাকে ‘মাস্টার সাব’ সম্মোধন করতো। এজন্য তার বড় পরিচয় একজন আদর্শ শিক্ষক; সাবেক চেয়ারম্যান নয়।

আমি তার নিকট পড়িনি কিন্তু আমার ভাইবোনসহ তার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে, তাদের থেকেই মহান এই মানুষটি সম্পর্কে জেনেছি এবং ইউনিয়নের একজন সাধারণ নাগরিক হওয়ায় একাধিকবার সভাসমাবেশ ও বিভিন্ন স্থানে তার আলোচনা শুনেছি। সেজন্যই তাকে নিয়ে আজকের স্মৃতিচারণ।

রাজনৈতিক আলোচনা করলেও মাস্টার সাহেবের কথায় সবসময় কিছু না কিছু শিক্ষণীয় উপদেশ থাকতো। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা যেন তার কথা থেকে কিছু শিখতে পারে তিনি সম্ভবত এটা খেয়াল করেই কথা বলতেন। কোন্দারদিয়া দাখিল মাদ্রাসার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, আমি বিটিভির ‘স্মরণীয় বরণীয়’ অনুষ্ঠানটি দেখি এবং এটা সবাইকে দেখতে বলি, কারণ, ছাত্র-ছাত্রীরা এখান থেকে বড় হবার অনুপ্রেরণা পেতে পারে।

জনপ্রতিনিধি হয়েও তিনি খুব স্বল্পভাষী ছিলেন। তবে শ্রেণিকক্ষে হাজির হতেন একজন রসিক শিক্ষক হয়ে। বড়বোন থেকে তার মুখের অসংখ্য রম্যকাহিনি শুনেছি। আর সব কাহিনিতেই শিক্ষণীয় একটি দিক অবশ্যই থাকতো। 

সাহিত্যে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল। রাঙ্গামুলারকান্দি স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিনি খুব সুন্দর সুন্দর গান- কবিতা রচনা করতেন। এবং নিজেই সুর করে মূল অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে ওই গান পরিবেশন করাতেন। তার রচিত গানে আগত বড় বড় শিক্ষাবিদ অতিথিরাও মুগ্ধ হতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারেও তার লিখিত গান প্রচারিত হয়েছে। খ্যাতিমান কবি হিসেবে জাতীয় অঙ্গনসহ তিনি অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। 

মাস্টার ইউনুস আলি মিয়া মানবিক প্রকৃতির একজন কবি ছিলেন- সেই থেকেই তিনি রচনা করেন কাব্যগ্রন্থ ‘শ্মশান গোরস্থান’। এ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে অবদানের সাক্ষী স্বরূপ তিনি একাধিক কাব্যগ্রন্থ রচনা করে গেছেন- এরমধ্যে শয়তানের ভাই, প্রেমাঞ্জলি, ফুলপাখি ও ভাগ্যরজনী উল্লেখযোগ্য। 

তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালীন দাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের নতুন স্থাপনা উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও তার রচিত একটি গান পরিবেশিত হয়। সেদিন গান শুনে এবং তার কর্মদক্ষতার প্রশংসা করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তৎকালীন ফরিদপুর জেলা প্রশাসক ইয়াহইয়া ভূইয়া। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে এমন শিক্ষাবিদ জনপ্রতিনিধির বিকল্প আর কিছু নেই। 

মাস্টার ইউনুস আলি মিয়া নিজ গ্রামে কোন্দারদিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। একই সঙ্গে শিশুদের শিক্ষার জন্য নিজের মায়ের নামে কোন্দারদিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন সবজান খাতুন কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এ ছাড়াও এলাকার শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য তার অবদান অনেক। 

পিতা হিসেবেও তিনি ছিলেন চমৎকার। তিন পুত্র ও দুই কন্যাকে সুশিক্ষা প্রদান করেছেন। তার বড় ছেলে আরিফুল ইসলাম ব্যাংক কর্মকর্তা এবং মেজ ছেলে তারিকুল ইসলাম সালথা উপজেলার বিভাগদী শহীদস্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। 

মোটকথা, একজন আদর্শ সচেতন মানুষ হিসেবে যে যে গুণ থাকা দরকার তার বেশিরভাগই মাস্টার মুহাম্মাদ ইউনুস আলি মিয়ার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। পরিবেশ রক্ষায়ও তিনি খুব যত্নশীল ছিলেন, তার বাড়ি ‘কবিকুঞ্জ’কে পরিবেশবান্ধব করেই গড়ে তুলেছেন। পশুপাখি পালনেও এলাকাজুড়ে তার সুনাম ছিল। 

একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তার সর্বমুখী এসব বুদ্ধি-বিবেচনা ও প্রতিভার কারণে দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে আলাদা শ্রদ্ধার নজরে দেখতো। তাই তাকে হারিয়ে সবাই একজন মহান মানুষের অভাববোধ করছে আজ অবধি। আল্লাহর নিকট দোয়া করি, তাকে তিনি জান্নাত দান করুন এবং তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকুক দীর্ঘকাল।

লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর