Logo
Logo

জীবনানন্দ

গল্প

নিঃশব্দ বেদনা

Icon

মাহবুবুল হক বুলবুল

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:২৩

নিঃশব্দ বেদনা

রাগের মাথায় ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলাম ওর গালে। মেজাজটা ঠিক ছিল না। ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার পর অনার্স ভর্তির জন্য কারমাইকেল কলেজে পরীক্ষা দিয়েছি। আজ পরীক্ষার ফল বের হবে। রেজাল্ট শিটে রোল নম্বর না থাকায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি আর ভর্তি হতে পারলাম না। তৃতীয় ভবনের সামনে কদম গাছের শেকড়ে বসে পিছন দিকে হেলান দিয়ে ভাবছি নানা কথা। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে বাবা মার কথা। কী বলে বোঝাব ঠিক বুঝতে পারছি না। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলো, পারলাম না। খুব যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে। কান দুটো গরম হয়ে উঠছে। চোখ দিয়ে যেন গোল্লা গোল্লা আগুন বের হচ্ছে। যন্ত্রণায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। জীবনের সর্বটুকু আশা স্বপ্ন সব, সব ব্যর্থতার ঘোলা জলে মিশে একাকার। চোখের সামনে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। আলোহীন এক অদক্ষ নাবিকের মতো জীবনের ডিঙি নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে চলছি তো চলছি।

লেখা পড়ায় খুব একটা ভাল ছিলাম তাও না। আবার একেবারে গড্ডামার্কা তাও না। জীবনে কোন পরীক্ষায় ফেল করিনি। কিন্তু আজকের এই প্রথম পরাজয়টাকে মেনে নিতে পারছি না কোনোভাবেই। এমন সময় কুড়ানি এসে বললো, ‘মালা নেবেন? বকুল ফুলের মালা? টাটকা আছে।’ নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। কোনো কথা না বলে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম ওর গাল বরাবর। 'মাগো' বলে একবার চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর কোনো কথা না বলে উঠে তার বাম হাত দিয়ে গালটা ঘষতে লাগলো।

এগারো বছরের বালিকা। প্রতিদিন কলেজে এসে মালা বিক্রি করে। ওর আসল নাম কেউ জানে না। সবাই ওকে কুড়ানি বলে ডাকে। কলেজের প্রায় সবার কাছেই পরিচিত। একদিন ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই খুকি কী নাম তোর? ও বলেছিল কুড়ানি।

-থাকিস কোথায়?

-বস্তিতে।

-কে কে আছে তোর?

-কেউ নেই। দূর সম্পর্কের এক দাদীর কাছে থাকি। দাদি বুড়ো হয়ে গেছে। তাই কেউ তাকে কাজে নেয় না। ভিক্ষে করে। আমি ফুলের মালা বিক্রি করি।

-মালা কত করে বেচিস?

-দুই টেকা।

-দে আমাকে একটা। একটা দশ টাকার নোট বের করে দিয়েছিলাম।

কুড়ানি বলেছিল, আমার কাছে যে ভাংতি নেই? বলেছিলাম ভাংতি লাগবে না। পুরোটাই নিয়ে নে। কুড়ানি প্রথমে ইতস্তত করছিল। নিতে চাইছিল না। আমি জোর করেই দিয়েছিলাম। কেন জানি ওর উপর একটা মায়া পড়েছিল। বাকি টাকা ফেরত নিতে ইচ্ছে হলো না। কুড়ানি একবার দশ টাকার নোটের দিকে আরেকবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। শেষবার আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে গেল।

কুড়ানি তার বাবাকে জানে না। দাদীর কাছে শুনেছে জন্মের আগেই তার বাপ মারা যায়। অভাবের তাড়নায় তার মা এক বছরের কুড়ানিকে রেখে আত্মহত্যা করে। কুড়ানি তখন একা। সকাল হলেই ফুল কুড়াতে যায়। সে ফুলের মালা গেঁথে বিক্রি করে খায়। পরনে একটা ঘিয়ে রঙের ফ্রক। তাতে ফুল জাতীয় কিছু আঁকা আছে। চুলগুলো বুক ছুঁই ছুঁই করছে। তেলের অভাবে লালচে হয়ে গেছে, এলোমেলো রুক্ষ্ম। ক্ষীরের চেহারায় ময়লা জমে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখ দুটো বড়ো বড়। নারী শোভা বর্ধনের জন্য বাড়তি কোনো অলংকার নেই। কেবল দু-চারটে বকুল ফুলের মালা গলায় পেঁচানো। দুহাতেও মালা ভর্তি। সারাদিন ফেরি করে বেড়ায়।

ওর কোনো স্বপ্ন নেই, কোনো আশা নেই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সাধ তার কোনোদিন হয়েছিল কি না কে জানে। চার চাকার গাড়িতে চরে বেড়ানোর স্বপ্নও কল্পনাতীত। প্রতি শুক্রবার গীতার মা যে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সেখানে সে গীতাসহ টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখতে যায়। কুড়ানির কথাবার্তা বেশ চটপটে। কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে বেশি মিশতে পারে। 

তরুণীরা যাতে ফুল কুড়াতে না পারে সে জন্য দুষ্ট ছেলেরা মর্নিং ওয়াক করতে এসে ফুলগুলো মাড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু এই ফুল দিয়েই কুড়ানিদের জীবিকা চলে তা তারা খেয়াল করে না। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে এসে কুড়ানি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যায়, মালা গাঁথে, বিক্রি করে।

কুড়ানি একদিন অভিযোগ করে বলেছিল ছেলেরা খুব দুষ্ট। পা মাড়িয়ে ফুলগুলো সব নষ্ট করে দেয়। তাকে বলেছিলাম তোর জন্য একটা বকুল গাছ লাগিয়ে দেবো। গাছে ফুল ফুটবে, ফুল ঝরবে। তুই শুধু একাই ফুল কুড়াবি। সেখানে আর কেউ ফুল নষ্ট করতে আসবে না। একগাল হেসে কুড়নি বলেছিল, আচ্ছা। কুড়ানির হাসিতে ছিল একটা গভীর বিশ্বাস। আমার কথায় আস্থা পেয়েছিল, স্বস্তি পেয়েছিল।

কিন্তু আমি বোধ হয় ওকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম। হয়তো কেবল সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, সবাই যে রকম বলে থাকে, সে রকমই বলেছিলাম। কেন না, চারা লাগালেই ফুল হয় না।

এমএইচএস 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর