Logo

জীবনানন্দ

অদ্বৈত মল্লবর্মণ : প্রগাঢ় মমত্ববোধের অভিজাত ভাষাশিল্পী এক

মেহেদী হাসান শোয়েব

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৫৪

অদ্বৈত মল্লবর্মণ : প্রগাঢ় মমত্ববোধের অভিজাত ভাষাশিল্পী এক

বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু লেখক আছেন, যাদের জীবন ও সাহিত্য একে অপরের পরিপূরক। তাদের সাহিত্য শুধু শিল্পরস নয়—সময়, সমাজ ও শেকড়ের দলিল হয়ে ওঠে তা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তেমনই একজন, যিনি শুধু সাহিত্য রচনা করেননি, বরং কালো অক্ষরের জাদুতে গোটা জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মার ভাষা রূপান্তর করেছেন বর্ণমালার শিল্পে।  

তার সর্বাধিক আলোচিত ও কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসকে খ্যাতিমান সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস অভিহিত করেছেন ‘জেলে জীবনের পাঁচালি’ হিসেবে। পদ্মা নদীর মাঝি থেকে শুরু করে গহিন গাঙ, অবগাহন—জেলে জীবনভিত্তিক যত উপন্যাসই রচিত হোক না কেন, ‘তিতাস’-এর সমতুল্য কিছু নেই, এমনই মনে করেন জলদাস। অদ্বৈত যে জীবনযাপন করে গেছেন, সেই জীবনেরই বর্ণময় চিত্ররূপ হয়ে উঠেছে তার সাহিত্য।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গোকর্ণঘাটে, তিতাস নদীর তীরে। তিনি ছিলেন ধীবর (মালো) সম্প্রদায়ের সন্তান। এই পরিচয় কেবল সামাজিক অবস্থান নয়, বরং তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু এবং সাহিত্য সৃজনের রসদ। অদ্বৈতের জন্মপরিচয় এবং পারিবারিক দারিদ্র্য তাকে এক কঠিন জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করায়। শৈশবে হারিয়েছেন মা-বাবা এবং বাকি তিন ভাইবোনকে। এমন দুঃখভারাক্রান্ত জীবন থেকেও তিনি উঠে এসেছেন শিক্ষার আলোয়, লেখালেখির ভুবনে।

তার পড়াশোনা হয়েছিল ধীবর সম্প্রদায়ের লোকদের চাঁদা তুলে দেওয়া টাকায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা স্কুল, পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ—সেই শিক্ষাজীবনও আর্থিক সংকটে ব্যাহত হয়েছিল। কলকাতায় গিয়ে তিনি জীবিকার তাগিদে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। ‘ত্রিপুরা’, ‘নবশক্তি’, ‘মোহাম্মদী’, ‘আজাদ’, ‘নবযুগ’, ‘যুগান্তর’সহ বহু পত্রিকায় কাজ করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, আকরাম খাঁ, বুদ্ধদেব বসু—এইসব ব্যক্তিত্বদের সাহচর্য তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। গড়ে তুলেছে এক অনন্য ভাষাশিল্পী হিসেবে।

অদ্বৈতের সাহিত্যজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি নিম্নবর্গের মানুষের জীবন ও ভাষাকে তুলে এনেছেন অনবদ্য মুন্সিয়ানায়। তার সাহিত্যে শহুরে বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কৃত্রিম যন্ত্রণা নেই। আছে প্রকৃত দারিদ্র্য, সংগ্রাম এবং ঐতিহ্যের এক নির্মম অথচ সংবেদনশীল চিত্র। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি মৎস্যজীবী সমাজের জীবনচিত্রকে এতটাই গভীর ও মানবিকভাবে উপস্থাপন করেছে যে, এটি নিছক কাহিনি নয়, হয়ে উঠেছে যেন এক জীবনশাস্ত্র।  

তার উপন্যাসে ভাষার যে প্রাঞ্জলতা, তা একদিকে সাহিত্যের সৌন্দর্য আরেকদিকে সমাজতাত্ত্বিক দলিল। অদ্বৈতের ভাষা গ্রামীণ অথচ ভাবগম্ভীর। তিনি দেখিয়েছেন, ধীবরদের কথ্যভাষা, লোকজ ছড়া, পালা, গীত—সবই সাহিত্য হতে পারে। তিনি এসব উপাদানকে যে যত্ন ও মমতায় সাহিত্যে রূপান্তর করেছেন, তা সত্যিই অভিজাত ভাষাশিল্পীর কীর্তি।  

অদ্বৈতের সাহিত্য শুধু সমাজচিত্র নয়, হৃদয়ের গভীর মানবতাবোধেরও প্রতিফলন। তিনি ছিলেন অকৃতদার। নিজের আয়ে সংসার না গড়ে তিনি গড়েছিলেন অন্যের ভবিষ্যৎ—কলকাতার জেলেপাড়ার ছাত্রদের কল্যাণে ব্যয় করতেন উপার্জিত অর্থ। তার এই ত্যাগই প্রমাণ করে, তিনি কেবল সাহিত্য রচনা করেননি, শব্দের বুননে এঁকেছেন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। 

তার গদ্য ও প্রবন্ধে যে অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়, তা তাকে শুধু সাহিত্যিক নয়, একজন ফোকলোর গবেষক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করে। ‘বর্ষা মঙ্গল’, ‘আম্রতত্ত্ব’, ‘জলসওয়া গীত’—এইসব রচনায় তিনি বাংলা লোকসাহিত্য, গান, ছড়া, বারোমাসি, পালা এসবকে লিপিবদ্ধ করেছেন এক প্রামাণ্য ভঙ্গিতে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ একধরনের নীরব নৃতাত্ত্বিক, যিনি লোকসাহিত্যের সঞ্চয়পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন নিজেই।

মাত্র ৩৭ বছরের ক্ষণজন্মা জীবনে তিনি রচনা করেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সাদা হাওয়া’, ‘রাঙামাটি’ উপন্যাস; ১৪টি কবিতা, ৫টি গল্প ও প্রায় ২৪টি প্রবন্ধ। এই অল্প রচনার মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার প্রান্তিক জীবনের বিশুদ্ধতম এক কণ্ঠস্বর।  

তার শেষ লেখা গল্প ‘স্পর্শ দোষ’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। ‘সন্তানিকা’ গল্পে নিজের দারিদ্র্যপীড়িত ছাত্রজীবনের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এমন আত্মজীবনীমূলক ঘনিষ্ঠতা তার সাহিত্যে এক ধ্রুপদী ব্যঞ্জনা এনেছে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যে এক শ্রেণিহীন, সীমাহীন মানবতার কণ্ঠস্বর। তার ভাষা যেমন সহজ, তেমনি শৈল্পিক। তার দৃষ্টিভঙ্গি যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি অন্তর্মুখী। তার সাহিত্য যেমন প্রামাণ্য দলিল, তেমনি আবেগের নিখুঁত ছায়াচিত্র।  

তিনি প্রমাণ করে গেছেন, সাহিত্য কেবল অভিজাতদের মুখপাত্র নয়, সাহিত্যের ভাষায় নিম্নবর্গের আত্মকথাও উচ্চারিত হতে পারে—অভিজাত রূপে।  

অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাই কেবল একজন সাহিত্যিক নন, তিনি এক ভাষাশিল্পী, যিনি জীবন, ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও মানুষের গভীরতম আবেগকে প্রগাঢ় মমত্ববোধে রূপ দিয়েছেন অমর সাহিত্যে।

দারিদ্র্য, অনাহার ও অতিশ্রমের কারণে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৫১ সালে ১৬ এপ্রিল মাত্র ৩৭ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় অভিজাত ভাষাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণের।

তাঁকে স্মরণ করি শ্রদ্ধার সাথে। 

মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর

  • বাংলাদেশের খবরের জীবনানন্দ (সাহিত্য) বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bksahitya247@gmail.com 

এমএইচএস 


Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর