গীতিকার, সুরকার, লেখক, নায়ক—শব্দগুলোর সাথে ভালোভাবে পরিচিত হতে একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছাতে হয়েছিল। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় এক সহপাঠীকে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সুরকার কাদেরকে বলে?’ সে আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল, ‘সুরকাররা গান গাওয়ার ধরনে ভিন্নতা আনেন, না হলে সব গান একই রকম শোনাবে।’ এভাবেই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হতে শুরু করি।
তবে ‘কবি’ শবে সাথে পরিচিত ছিলাম আরও ছোটবেলা থেকেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বইয়ে নানান ছড়া ও কবিতা থাকত। শেষ পৃষ্ঠায় কবি পরিচিতি দেওয়া থাকত—কবির জন্ম, মৃত্যু, পড়াশোনা, গ্রামের বাড়ি, জেলা, বিভাগ ইত্যাদি। তখন থেকেই কবিদের অন্যদের চেয়ে খানিকটা আলাদা মনে হতো। পাঠ্যবইয়ের পরিচিতিতে থাকা বেশিরভাগ কবিই জীবিত নন। তাই মনে হত, কবিরা থাকেন মানুষের মনে।
কবি হিসেবে কোনো তরুণ যেনো বেমানান, আমার এই ধারণা খানিকটা অদ্ভুত ছিল। মনে হতো, কবিরা একটু বুড়ো প্রকৃতির; যেন কবি হতে গেলে বয়স, অভিজ্ঞতা আর পরিপক্বতা বাধ্যতামূলক। ধীরে ধীরে এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। নেতিবাচক অর্থে বলছি না। বরং একজন কবির ছন্দে আমি আমার যেকোনো অবস্থার মিল খুঁজে পাবো। মনে হতো, তিনি আমার কথা বলবেন।
কেউ টুকটাক গান গাইলে আমরা তাকে গায়ক বলি, গড়ের মাঠে টুকটাক ভালো খেলতে জানলে তাকে খেলোয়াড় বলা হয়। হোক অনুপ্রেরণার জন্য। আমি তা মেনেও নিই। এমনকি আমিও এমন তকমা দিতে অভ্যস্ত। কিন্তু কেউ একজন টুকটাক কবিতা লিখতে পারলেই তাকে কবি বলতে পারিনি। হতে পারে এটা আমার দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। অথবা নায়ক-গায়কদের চেয়ে কবিদের টিভি পর্দায় কম দেখা পাওয়ার কারণ।
তবে সময়ের সাথে এই ধারণা বদলাচ্ছে। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে কবিদের সবার মাঝে পাওয়া যাচ্ছে। কবি শব্দের ব্যবহারও বাড়ছে। কবিতা চর্চা অনেক বেশি হচ্ছে, যা অনুপ্রেরণাদায়ক। আগে কবিতা ডায়েরির পাতায় আটকে থাকত। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ‘কবি’ শব্দটি শিল্পী, খেলোয়াড় এবং অন্যান্য পেশার নামের মতোই সহজ হয়ে উঠবে। হয়তো এ ‘কবি’র ভিড় লেগে যাবে। আত্মস্বীকৃত কবিদের কারণে সত্যিকারের যিনি কবি, তিনি হয়তো হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করবেন, যেমন বর্তমানে গানের জগতে দেখা যায়।
মানুষ সবসময় প্রত্যাশা নিয়ে বাঁচে। প্রত্যাশা না থাকলে ভবিষ্যৎ নিষ্প্রাণ ও নিরস মনে হয়। স্রষ্টাও তাঁর সৃষ্টির যথাযথ প্রশংসা প্রত্যাশা করেন। তা না পেলে তিনি অসন্তুষ্ট হন।
২০০৬ সালে টেলিভিশনে কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুসংবাদ দেখে মন খুব খারাপ হয়েছিল। ২০১৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তাঁর নামের বানান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন ভেবেছিলাম, একজন মানুষ কত গুরুত্বপূর্ণ হলে তাঁর নাম পরীক্ষার প্রশ্নে আসে। তবে জীবিত অবস্থায় তিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন কি না, জানি না।
কবিদের মধ্যে সাধারণত লোভ-লালসা কম থাকে। কোনো বিখ্যাত কবি কি সরকারের কাছ থেকে ফ্ল্যাট বা প্লট পেয়েছেন? জানি না। অথচ সরকার বদলে গেলেও কবিরা বেঁচে থাকেন তাঁদের লেখায়, লাইব্রেরিতে বইয়ে পাতায়।
সেদিন ফেসবুকে কবি নির্মলেন্দু গুণকে পেলাম। ৭৪ বছর বয়সেও তিনি লিখে চলেছেন। তরুণ-বৃদ্ধ সবার কাছে তাঁর লেখা পৌঁছে যাচ্ছে। তাঁকে আর মুদ্রণের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। তাঁর অসংখ্য বিখ্যাত কবিতা আছে। অথচ জানি না, তাঁকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো ভিআইপি সুবিধা দেওয়া হয় কি না।
কবি ও কবিতা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁদের ছাড়া সমাজের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কিংবা ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির!—এমন কবিতা যতদিন থাকবে, তরুণদের সাহসের ঘাটতি হবে না।
কবিদের জয় হোক। কবিরা দীর্ঘায়ু হোক।
নাঈম রহমান : এক্সিকিউটিভ, কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশের খবর
এমএইচএস