Logo
Logo

জীবনানন্দ

নারীর অবরুদ্ধতা ভাঙার স্বপ্ন দেখতেন রাবেয়া খাতুন

Icon

মিসবাহ জামিল

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫

নারীর অবরুদ্ধতা ভাঙার স্বপ্ন দেখতেন রাবেয়া খাতুন

রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পরিবারের রক্ষণশীলতার কারণে প্রবেশিকার (মাধ্যমিক) গণ্ডি পেরোতে পারেননি। সেখানেই তার পড়াশোনার ইতি ঘটে। ফলে ভালোভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম হন মুসলিম নারীদের দুঃখ-দুর্দশার মূর্তি-চিত্র। এই দুর্দশার মূর্তি ভাঙতেই আজীবন চালিয়েছেন কলম-সংগ্রাম। নারীদের বন্দিদশা থেকে বের করে আধুনিক সমাজের উপযোগী হওয়ার প্রেরণাই দিয়ে গেছেন গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের মাধ্যমে। পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল সমাজে নারীদের দমিয়ে রাখার যে বেড়াজাল, তার কলম চলত তা ছিন্ন করার লক্ষ্যে। নারীর অবরুদ্ধতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন তিনি। আজ সেই কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের জন্মদিন। 

রাবেয়া খাতুনের সাহিত্য কর্মের বৈশিষ্ট্য বহুমুখী। লিখেছেন প্রচুর। তার সাহিত্যকর্মে সমাজের বাস্তব চিত্র অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জীবনযাপন, পারিবারিক সম্পর্ক, দারিদ্র্য ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের টানাপোড়েনকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরেছেন।  ‘মধুমতি’ উপন্যাসে সমাজের চিরায়ত সমস্যাগুলো সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার আজন্ম লড়াই ছিল প্রগতিশীল সমাজ গঠনের লক্ষ্যে। আর নারীর মুক্তি। 

নারীজীবনের বিভিন্ন দিক তার লেখায় উঠে এসেছে। নারীর প্রেম, প্রতীক্ষা, আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও সামাজিক অবস্থানের বিষয়গুলো অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে প্রকাশ করেছেন রাবেয়া খাতুন। উপন্যাসে নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সমাজে তার অবস্থান কীরকম, তার ধারণা তুলে ধরেছেন। সেটি থেকে পরিত্রাণের ইশারাও পাওয়া যায়। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম রাবেয়া খাতুনের সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি তাঁর রচনায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক—যেমন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও যুদ্ধপরবর্তী মানুষের সংকট তুলে ধরেছেন। তাঁর রচনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃজনশীলতার সঙ্গে বাস্তবতার মিশেলে চিত্রিত। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেঘের পর মেঘ’ অবলম্বনে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

মানবমনের গভীর অনুভূতি ও সম্পর্কের জটিলতা রাবেয়া খাতুনের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি পারিবারিক সম্পর্ক, প্রেম, বিরহ ও বন্ধুত্বের জটিলতাগুলোতে গভীরভাবে দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে উপন্যাসে পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের দিকটি নিয়েই আলোচনা করেছেন।

রাবেয়া খাতুনের ভাষা ছিল সহজ ও সাবলীল। তিনি সাধারণ ভাষায় গভীর চিন্তা এবং সমাজের বিভিন্ন দিক প্রকাশ করতেন, যা তাকে পাঠকের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তার লেখায় প্রাঞ্জল ভাষার ব্যবহারের ফলে পাঠক সহজেই তার কাহিনির অন্তর্জগতে পৌঁছতে পারেন।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তাঁর লেখায় বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি গ্রামীণ জীবনের সরলতা ও শহুরে জীবনের জটিলতাকে তুলনামূলকভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় চরিত্রচিত্রণ ছিল অত্যন্ত বাস্তব ও বহুমাত্রিক। তাঁর চরিত্রগুলো জীবন্ত ও মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ। পাঠক তাদের সঙ্গে সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারেন।

তিনি সমাজের অন্যায়, বৈষম্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। তার সাহিত্যে শোষিত ও অবহেলিত মানুষের পক্ষে একটি নীরব কিন্তু দৃঢ় প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়। সচেতন পাঠক মাত্রই এটি লক্ষ করে থাকবেন।  অনেক ছোটগল্প ও প্রবন্ধে তিনি সমাজের বৈষম্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে নারীদের প্রতি বৈষম্যের খড়্গ থেকে রক্ষার বিষয়ে চিন্তার যোগান দিয়েছেন।

রাবেয়া খাতুন শুধু উপন্যাস বা ছোটগল্পেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিচারণমূলক রচনা ও নাটকেও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি উপন্যাস লিখেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘মধুমতী’, ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’, ‘ফেরারী সূর্য’, ‘বাগানের নাম মালনীছড়া’, ‘ঘাতক রাত্রি’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘মন এক শ্বেত কপোতী’, ‘সেই এক বসন্তে’, ‘রঙিন কাচের জানালা’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘আকাশে এখনো অনেক রাত’, ‘সৌন্দর্য সংবাদ’, ‘ছায়া হরিণী’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও চারশোরও বেশি ছোটগল্প লিখেছেন তিনি।  

রাবেয়া খাতুন ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার বিক্রমপুরে মামার বাড়িতে তার জন্ম হয়।  তবে তার পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে। তার বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ এবং মা হামিদা খাতুন। আরমানিটোলা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (বর্তমানে মাধ্যমিক) পাস করেন ১৯৪৮ সালে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় বিদ্যালয়ের গণ্ডির পর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। 

বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক (১৯৯৩), স্বাধীনতা পদক (২০১৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩),   নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫)-সহ বহু পুরস্কার পাওয়া এই লেখক ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি পরলোকে পাড়ি দেন।

মিসবাহ জামিল : সহসম্পাদক, বাংলাদেশের খবর

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর