সৈয়দ শামসুল হক : সৃষ্টি আর বৈচিত্র্যের মুগ্ধতা
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৭
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী লেখক। বৈচিত্র্য ও গভীরতা তাঁকে অনন্য করেছে। সাহিত্যের যেমন যা কাজ—মানুষের মনকে সংবেদনশীল করে তোলা, আনন্দ দেওয়া, কখনও আন্দোলিত করা—সৈয়দ হক এসব করতে পারায় সফলতমদের একজন। বাংলা সাহিত্যের আকাশে দীপ্তিমান নক্ষত্র; ক্লান্তিহীন অনুসন্ধানী যেন এক। সৃজনশীল, চমক জাগানো কাজ তার মত করে করেছেন, কেউ কি আছে আর এই বাংলায়?
সৈয়দ হককে বলা হয় সব্যসাচী লেখক। কবি হিসেবে সর্বাধিক খ্যাতি পেলেও তাঁর কাজের পরিধি বিস্তৃত। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত, অনুবাদ, সমালোচনা, মঞ্চ নাটক, সিনেমার স্ক্রিপ্ট, সাংবাদিকতা, কলাম কোথায় নেই সৈয়দ হক? সকল ক্ষেত্রেই যোগ করেছেন নবতর মাত্রা।
ছোটগল্পের বই ‘তাস’ দিয়ে শুরু করেছিলেন। প্রথম বইয়েই কেড়েছিলেন পাঠক-সমালোচকের নজর। জানিয়ে দিয়েছিলেন, হক সাহিত্য জগতে বেড়াতে আসেননি, রাজত্ব করতে এসেছেন। ক্রমেই তিনি পাঠককে চিনিয়েছেন তাঁর নিজের ভাষা। তাঁর গদ্য পাঠেও কবিতার মতো আনন্দ পাওয়া যায়। আবার নিজের অঞ্চলের ভাষার সার্থক ব্যবহার করেছেন এমন দারুণভাবে যে তা আর আঞ্চলিক ভাষা হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে সব বাঙালির কণ্ঠস্বর। ‘আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায় দিবে ডাক,’ শুনলে অজান্তেই বাঙালি অস্ফুটে বলে ওঠে—‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’ নিজের ভাষায় সকলের স্বর হয়ে উঠতে পারায় সৈয়দ শামসুল হক অনন্য, অতুলনীয়।
সৈয়দ হকের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ক্রমাগত নিজেকে ভেঙেছেন। তাঁর প্রতিটি রচনায় পাঠকের জন্য নতুন কিছু দিয়েছেন। নতুন চিন্তার বীজ বপন করেছেন। তাঁর সাহিত্য পাঠককে ভাবায়, চিন্তার গভীর স্তরে নিয়ে যায়। পৃথিবীর নানা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তিনি। সেসবের প্রেরণা গ্রহণ করে গড়ে তুলেছিলেন নিজের ভাষাশৈলী।
সৈয়দ হকের কবিতার স্বর তার নিজস্ব। কবিতার পথচলাতে তিনি খোঁজ করেছেন, খোঁজ দিয়েছেন বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যের হাজার পদচিহ্নের। উদাত্ত স্বরে বলেছেন, ‘তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই/ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ অনুভূতির তীব্রতার সাথে জীবনের বৈচিত্র্যও তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। সমাজের নানা আঙিনায় ছড়িয়ে থাকা বাস্তবতার চিত্র এঁকেছেন নিবিড় অনুভূতির মিশেলে। কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষ এমনভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?/ পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?/ সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
বিশেষভাবে, তাঁর নাটক ও উপন্যাসে মানবিক গভীরতা এবং জীবনবোধের যে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে তা বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন অপরিহার্য সম্পদ হয়ে উঠেছে। বাংলা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, সাম্যবাদ, প্রেম—সবক্ষেত্রেই তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর উপলব্ধির সার্থক প্রকাশ করেছেন সাহিত্যের নানা মাধ্যমে।
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কিংবদন্তিতুল্য এই সাহিত্যিক প্রয়াত হন।
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর সৃষ্টি দিয়ে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের মননে বেঁচে থাকবে চিরকাল। ৯০তম জন্মদিনে সব্যসাচী লেখক, বাংলা সাহিত্যের এই নক্ষত্রকে স্মরণ করি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়।
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
এমএইচএস