Logo

জীবনানন্দ

জসীম উদ্দীন : পল্লিবাংলার আধুনিক কবি এক

Icon

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:২৮

জসীম উদ্দীন : পল্লিবাংলার আধুনিক কবি এক

যদিও তাঁর পরিচয় ও খ্যাতি পল্লীকবি হিসেবে, তবে তিনি কেবল পল্লির কবি নন। বরং বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিদের মধ্যে অন্যতম কবি জসীম উদ্দীন। তাঁর কবিতা পল্লিজীবন ও প্রকৃতির গভীর চিত্রকল্পে নির্মিত। গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম এবং সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে কবিতা রচেছেন তিনি। তাঁর ভাষায় মাটির ঘ্রাণ। শব্দে মটরশুটির বুনন। ছন্দে মানুষের কথা। এসবের ভেতর দিয়ে সমাজ সচেতনতা এবং জীবনবোধের গভীর মায়াময় প্রকাশে তিনি কবিতার আধুনিকতাকে স্পর্শ করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। 

জসীম উদ্দীনের সাহিত্যকর্মের শুরু পল্লিসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়া-সময়ে দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। এমএ পাস করার পর ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে রামতনু লাহিড়ী গবেষণায় দীনেশচন্দ্র সেনের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৪ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।  

জসীম উদ্দীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবনের তীব্র অনুভূতি ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কবিতায় গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাখালী (১৯২৭) প্রকাশিত হওয়ার পরেই কবি হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করতে শুরু করেন।

জসীম উদ্দীন সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করেছেন, যেমন গাথাকাব্য, খণ্ডকাব্য, নাটক, স্মৃতিকথা, শিশুসাহিত্য, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাখালী ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো— নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), মাটির কান্না (১৯৫১), সুচয়নী (১৯৬১), পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৭২), পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১), পল্লীবধূ (১৯৫৬), গ্রামের মায়া (১৯৫৯), ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় (১৯৬১), জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫), স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮), বাঙালীর হাসির গল্প, ডালিম কুমার ইত্যাদি। তাঁর লেখা বাঙালীর হাসির গল্প (দুই খণ্ড, ১৯৬০ ও ১৯৬৪) এবং বোবা কাহিনী (১৯৬৪) উপন্যাস দুটি পাঠকসমাদৃত।

জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। পাকিস্তান সরকার ১৯৬০-এর দশকে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিলে তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬৬-৭১ সালের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি তার সমর্থন ছিল স্পষ্ট। তার সাহিত্যে সমাজের অধিকারবঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পায়। একাত্তরের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জসীম উদ্দীন নিজের দেশে থেকে যুদ্ধ-অধ্যুষিত এবং রক্তাক্ত দেশের জন্য কবিতা রচনা করেছিলেন। কবিতাই যেন তখন হয়ে উঠেছিল তাঁর শক্তিশালী অস্ত্র। তাঁর ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি পঙ্‌ক্তি বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা ও যুদ্ধরত জাতির প্রতি বিশ্ববিবেকের সহানুভূতি সৃষ্টি করার এবং একটি সমৃদ্ধ স্বাধীন দেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে এই কবিতাগুলো তিনি 'তুজম্বর আলি' ছদ্মনামে ভারত, রাশিয়া এবং আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন। অনূদিত হয়ে অনেক কবিতা তখন আমেরিকা ও রাশিয়ায় ছাপাও হয়েছিল। তাই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জসীম উদ্দীনের কবিতাও গভীরভাবে সম্পর্কিত। 

জসীমউদ্দীন শুধু কবি ছিলেন না, তিনি বাংলা লোকসংগীতের সংগ্রাহক ও সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি জারিগান এবং ১৯৭৭ সালে মুর্শীদা গান নামে দুটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন, যা বাংলা লোকসংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে। তিনি জারি গানের বৈশিষ্ট্য এবং তার ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন, যা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ কাজি হিসেবে বিবেচিত হয়।

জসীম উদ্দীন তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য অনেক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (১৯৬৯), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৭৮) লাভ করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

জসীম উদ্দীন ছিলেন একজন আপাদমস্তক কবি, যিনি পল্লিজীবনকে তাঁর কবিতায় অনন্য রূপে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর আগে তাঁর মতো করে বাংলার পল্লিকে নগরসভ্যতার অঙ্গনে আর কেউ উপস্থাপন করেনি। পল্লিবাংলার সাহিত্যে তিনি আধুনিকতার নতুন মাত্রা দিয়েছেন যা বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। 

জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। তার পিতা আনসারউদ্দীন মোল্লা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। শৈশবে ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯২১), রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ (১৯২৪) ও বি.এ (১৯২৯) পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ (১৯৩১) ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন জসীম উদ্দীন। 

পল্লিবাংলার আধুনিক কবি জসীম উদ্দীনের জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

এমএইচএস
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর