আমার বিয়ের পর থেকে প্রতি ইদ ও পুজোর ছুটিতে শ্বশুরবাড়ি ফরিদপুরে যাওয়া একেবারে আবশ্যিক একটি কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো। যদিও বা কোনো কোনো রোজার ইদে মা ও বন্ধুদের ডাকে জোর করে চলে যেতাম খুলনায়; কিন্তু পুজোয় কোনো ছাড়াছাড়ি নেই! পুজোর একমাস আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে যেতো--খুলনা না ফরিদপুর! নানা কায়দায় চেষ্টা করতাম খুলনার দিকে তার মন ফেরাবার, কতরকমের লোভ দেখাতাম! ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে মাঝেমধ্যে আবার মাকে দিয়ে চিঠিও লেখাতাম!
ছোটভাইটা ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। পুজোয় মায়ের কাছে যাওয়ার পথে ঢাকায় আমার বাসা হয়েই যেতো। সেও কতবার বলেছে, `পুজোয় আপনি আপনার মায়ের কাছে যান, আপনার মা খুশি হন। আমার মাও তো তার মেয়েকে পুজোর কিছুদিন নিজের কাছে পেলে খুশি হন!' কিন্তু কোনো যুক্তি-তর্কতেই ভবি ভুলবার নয়!
আসল কথা হলো আমি না গেলে ২০-২৫টা নারকেল কুড়িয়ে নানানরকম নাড়ু-সন্দেশ বানাবে কে? পুজোর মধ্যে যতজন বাড়িতে আসবে, তাদের জন্য প্লেট সাজিয়ে সামনে ধরবে কে? বিজয়ার পরদিন মহাভোজের ৪-৫ কেজি ময়দা মেখে লুচি বেলবে কে? স্বাদ করে নিরামিষ রাঁধার জন্য একঝুড়ি সবজি কাটবে কে? শুধু লুচিটা ভাজা আর নিরামিষ, ছোলারডাল রান্নাটা শাশুড়িই করতেন। আর বাদবাকি সব কাজ তো ‘বাড়ির বড় বউয়ের’ জন্যই বাঁধা!
ঘরে যদিও দুই দুজন সোমত্ত মেয়ে আছে কিন্তু ঘরে ভাইবউ থাকতে তারা বাপু কোন দুঃখে হাত নাড়তে যাবে! হোক না সে চাকরিজীবী, করুক না নিজের ঘরে সমস্ত কাজ একহাতে, থাক না শ্বশুরমহাশয় বারোমাস তার বাসায়, আসুক না কেন শ্বশুরকুলের গ্রামের আত্মীয়-কুটুম যখন-তখন! তাদের আপ্যায়নের কিন্তু একচুল পরিমাণ ত্রুটিও হতে পারবে না! বাড়ির বড় বউকে এসবই লক্ষ্য রাখতে হয় সবসময়!
প্রতিবছর সারাটা পুজোয় একই আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে পুজোটা আর আনন্দের থাকতো না, রীতিমতো আতঙ্কজনক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো! ঢাকায় ফিরে এসে আবার পরদিন থেকেই তো সেই চাকরি আর ঘর-সংসারের ঝক্কি সামলানো!
একবার পুজোর পর ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় ফিরছি। ১৯৮৪ সাল হবে বোধহয়। আমাদের বাসের পাশেই একটা লোকাল বাস দাঁড়ানো। সেই বাসে আমার সিটের সোজাসুজি বসা শ্যামলাবরণ ১৮-১৯ বছরের একটি বউ, পাশে ১৪-১৫ বছরের ছোটভাই বা দেবর বুঝিবা! মনে হলো বাপের বাড়িতে যাচ্ছে।
নিম্নবিত্ত ঘরের বউ। আধা ঘোমটা দেওয়া লাল একটা তাঁতের শাড়ি পরনে, হাতভরা লাল-সবুজ মেশান কাঁচের চুড়ি, কানে একজোড়া ছোট্ট সোনার মাকড়ি আর গলায় কালো কারে গাঁথা একটিমাত্র সোনার কামরাঙা।
তরুণ স্বামীটি সঙ্গে এসেছে বাসে তুলে দিতে। ২৪-২৫ বছর বয়স হবে। চোখে-মুখে দায়িত্ববোধের ঝকমকি! বৌয়ের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে আর টুকটাক কথাবার্তা বলছে। ওদের গাড়ি প্রায় ছাড়ার সময় হয়ে এল। স্বামীটি বউটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কেবল ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনি বউটি ছোট্ট করে ডাক দিলো, ‘এই, একটু শুনবা?’ স্বামী ঘুরে আবার বাসের জানালার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হইছে? কিছু বলবা? বল তাড়াতাড়ি। এখন আমারে তো আবার কাজে যাইতে হবে।’
বৌটি তখন একটু সময় নিয়ে সলজ্জমুখে চোখ দুটো নিচের দিকে নামিয়ে আহ্লাদি সুরে বলল, ‘একটা টাকা দিবা?’ ওইটুকু চাইতেই নিজেকে যেন কতক্ষণ ধরে তৈরি করেছে সে এবং একেবারে শেষ সময়ে আর না পেরে তাই স্বামীকে পিছু ডেকেই ইচ্ছেটা জানাতে হলো তার! আর কীই-না সামান্য চাওয়া! মাত্র একটা টাকা! হয়ত বাপের বাড়িতে যাওয়ার পর ছোট ভাই-বোনদের খুব সামান্য কোনো আবদার মেটাতে বা নিজের কোনো প্রয়োজন মনে করে চাওয়া!
স্বামীটি তাড়াতাড়ি পকেট হাতড়ে দায়িত্বশীল স্বামীর মত মুখ করে একটি নয়, দুটি একটাকার নোট বের করে বৌটির বাড়ানো হাতে দিতে দিতে বললো ‘আগে বলবা তো! যাও, সাবধানে যাইও। আর তোমার বাবা-মার দিকে খেয়াল রাইখো। লিলি-বেলিরে বইলো তাদের দুলাভাই ঈদের সময় যাবে।’ বউটির সলজ্জ মুখটা যেন খুশিতে পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলমল করে উঠলো! সেও খুশিতে খলবলানো গলায় বললো, ‘তুমিও সাবধানে থাইকো!’
ওদের বাসটা ছেড়ে দিলো। বউটিকে দেখলাম বাসের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পিছনপানে তাকিয়ে রইলে যতক্ষণ না তার স্বামী অদৃশ্য হলো!
সেদিনের পর আমার পৃথিবীতে আরও লক্ষ-কোটি ঘটনা ঘটেছে; কতশত মানুষের হাসি-কান্না, রাগ-অভিমানের অভিব্যক্তি দেখেছি, তাদের কথোপকথন শুনেছি। কিন্তু একজন স্বামীর কাছে অচেনা তরুণী বধূটির মাত্র একটি টাকা চাওয়ার সেই সলজ্জ কুণ্ঠিত মুখটির ছবিটি যেন আমার মনের মাঝে খোদাই হয়ে রইলো আজীবনের জন্য!
এমএইচএস