আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক কথাকার
রুদ্র জামান
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:৩২
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক, ছোট গল্পকার ও ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বাংলা সাহিত্যের আকাশে ষাটের দশকে লেখক হিসেবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উত্থান। জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বসূরি হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটে বাংলা সাহিত্যে। এ ক্ষেত্রে আরও দুইজন কথাসাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে কমলকুমার মজুমদার ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। এঁদের উত্তরসূরি হলেও তাঁর নিজস্ব স্বতন্ত্র জীবনোপলব্ধি, ভাষা ও বর্ণকৌশলে বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস।
প্রায় তিন দশক সাহিত্যলগ্ন থাকলেও তাঁর রচনার সংখ্যা আশ্চর্যরকমভাবে কম। তাঁর ছোটগল্প গ্রন্থিত এবং অগ্রন্থিত মিলিয়ে মোট ত্রিশটির বেশি নয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো যথাক্রমে; অন্যঘরে অন্যস্বরে (১৯৭৬), খোঁয়ারি (১৯৮২), দুধে ভাতে উৎপাত (১৯৮৫), দোজখের ওম (১৯৮৯), জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৬) এবং দুটি উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬), খোয়াবনামা (১৯৯৬)।
সমাজ-রাজনীতির ক্ষয়, নৈতিক অবক্ষয় এবং মানুষের অসুস্থতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। দুধে ভাতে উৎপাত গল্পে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সমাজ ও রাজনীতির চিত্র তুলে ধরেছেন, যেখানে ফুটে উঠেছে গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীর আবহমান চিত্র, যেখানে নিরন্ন মানুষের নিরন্তর জীবনসংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে; অব্যাহত রয়েছে উচ্চ বিলাসী শাসকবর্গের শোষণ।
বাংলা সাহিত্যে তিনজন স্বল্পপ্রজ লেখক ও কবি আছেন। তাদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অন্যতম, অন্য দুইজন হলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং কবি হেলাল হাফিজ (সদ্য প্রয়াত)।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে, আর খোয়াবনামা রচিত হয়েছে তেভাগা আন্দোলন, সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭) এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রেক্ষাপটে। এই দুটি উপন্যাসের মাঝেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেঁচে আছেন। কবি নজরুল ইসলামও মাত্র তিনটি উপন্যাস লিখেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঔপন্যাসিক হিসেবে বেশি বিবেচনা করা হয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছিল নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্যদৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ। এসবই তাঁর রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা। তাঁকে সমাজবাস্তবতার অনন্যসাধারণ রূপকার বলা হয়েছে। তাঁর রচনাশৈলী সম্পন্ন এবং আলাদা। তিনি দীর্ঘকালব্যাপী উপন্যাস রচনা করেছেন এবং প্রথম উপন্যাস রচনার এক দশক পরে দ্বিতীয় উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি একটি লেখা কয়েকবার সংশোধন করেছেন এবং উপন্যাসের বিষয়বস্তু বা উপাদান সংগ্রহের জন্য তিনি সেই ঘটনা স্থলে গিয়েছেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অর্জনসমূহ
- অন্যঘরে অন্যস্বরে গল্পগ্রন্থের জন্য বাংলাদেশ লেখক শিবির প্রদত্ত হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭),
- ছোটগল্পে বিষয় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৩),
- চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের জন্য আলাওল পুরস্কার (১৯৮৭),
- সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বিকাশ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯-৯০),
- কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার (১৯৯১),
- উপন্যাস খোয়াবনামার জন্য প্রফুল্ল কুমার সরকার আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৬),
- বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি প্রদত্ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬),
- ১৯৯৯ সালে একুশে পদক এবং ২০১৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন এবং প্রথমে করোটিয়া সাদাত বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৬ সালে তাঁর দেহে মরণব্যাধি ক্যানসারের জীবাণু ধরা পড়ে এবং ১৯৯৭ সালে ৪ জানুয়ারি মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধা রইল প্রিয় লেখকের প্রতি। তিনি একজন সফল ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক। আজও তিনি প্রাসঙ্গিক।
রুদ্র জামান : শিক্ষক, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী
এমএইচএস