গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
তোমার সঙ্গে আমার যখন
প্রথমবার দেখা হলো,
ওই যে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে
মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ি এলে যখন—
আমরা দুজন আমবাগানে খেলতাম
আর বেলী, শিউলি, হাসনাহেনা ফুল কুড়াতাম।
তোমার তখন আমাকে ভীষণ ভাল লাগছে
ভাবছো, আমাকে চিঠি লেখার ঠিকানা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে,
ঠিক তখনই মায়ের কাছ থেকে শুনলে,
খোকা, ও ঠিক আমাদের ক্লাসে মেলে না—
তুমি চুপসে গেলে তখন।
পরেরবার যখন আমাদের দেখা হলো
প্রায় ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে,
আমরা দুজনেই পরিণত—
আমি জবে জয়েন করেছি,
তুমিও তোমার দুই নটরডেমিয়ান বেস্ট ফ্রেন্ড বলল,
আরে তোর সাথে ওর যায় নাকি!
ও তো আমাদের ক্লাসে মেলে না—
তুমি আবার চুপসে গেলে তখন।
আবার ১০ বছর পর যখন আমরা দুজনে গবেষণার কাজে ব্যস্ত,
দুজনেরই একই গ্রুপে কাজ পড়ল;
তুমি ততদিনে আইনী শেকলে বাঁধা
মানে বিয়ে করে ফেলেছো!
তবে একটুখানি সাহসী হয়েছো এবার,
বন্ধুদের বললে, ও আমার টিমমেটের পাশাপাশি বেশ ভাল বন্ধুও।
‘আমরা দুজন আগে থেকেই পরিচিত’
এ কথা শুনে রাতে বাসায় ফিরে তোমার বউ বলল,
ও তো আমাদের ক্লাসে মেলে না
তুমি এত কথা বললে কেন?
তুমি আবার চুপসে গেলে তখন।
আবার ১০ বছর পর
তোমার মেয়ের ইউনিভার্সিটি এডমিশন,
ওকে নিয়ে তুমি খুলনা যাচ্ছো
আর আমি যাচ্ছি ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নিয়ে বাগেরহাট—
ওরা পরীক্ষার ছুটি কাটাচ্ছে তখন,
অনেক দিন পর প্রিয় মানুষকে পেয়ে তুমিও যেন শিশু হয়ে গেছো,
কী খুশি আর চঞ্চল ঠিক নিজের শিশুবেলার মতোন।
বুড়ো বাবার এমন ভীমরতি দেখে
তোমার মেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
বাবা তুমি এসব কী করছো?
এরা তো আমাদের ক্লাসে মেলে না,
তুমি আবার চুপসে গেলে তখন।
সেবার নাতনীর চোখ দেখাতে তুমি যাচ্ছো সিংগাপুর
আর আমি যাচ্ছি কনফারেন্সে যোগ দিতে,
এতদিন পর দেখা হওয়ায় তোমার খুশি দেখে কে!
তুমি তো ভেবেছ বাঙালি নারী কি আর অতদিন বাঁচে,
ঠিক কোনো একটা ক্যান্সারে মরে ভূত হয়ে গেছে,
চিকিৎসা করানোর মতো অত টাকা পাবে কোথায়?
রাষ্ট্রেরও তো অত ঠেকা নাই।
কিন্তু যখন দেখলে খুব খুশি হলে,
তোমার এত আদিখ্যেতা দেখে
তোমার নাতনীর তো অবস্থা খারাপ,
প্লেনের মধ্যে ওর জাত না যায় আবার...
কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
গ্র্যান্ডপা ডোন্ট ব্রেক ইওর ক্লাস,
তুমি আবার চুপসে গেলে তখন।
যখন পরিবারে আর থাকার জায়গা হলো না,
বয়স্ক মানুষকে বাড়িতে রাখলে অতি আধুনিক মানুষের জাত যায়—
ঠিক যেমন কুমারী মেয়ে ঘরে থাকলে মা-বাবা সমাজে-আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে সম্মান পায় না, তাই বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাবাস খুঁজে নিলাম।
পরিবারের ওরা বলছিল
শুধু নারীদের সাথে থাকতে,
এ কথা শুনে হাসলাম,
বললাম, এই বয়সে নারী-পুরুষ আবার কী হলো?
আমার তো সারাজীবন সহাবস্থানেই কাটল,
এখন নয় কেন?
আমি কি আর জানতাম যে, এটা তোমার সেই ব্যবসায়িক বেস্ট ফ্রেন্ড এর হোম
আর আইডিয়াটা তুমিই দিয়েছো!
আমাকে পেয়ে তুমি খুব খুশি,
তোমার সংসারের বহু শেকল নিজে থেকে এখন আলগা হয়ে গেছে।
প্রতিদিন চায়ের আড্ডা আর বুড়ো-বুড়িদের নিত্যনতুন রঙিন দিন
বেশ ভালই কাটতে লাগল,
তুমি আবার বিয়ের কথা ভাবতেই
ম্যনেজার তোমায় বলল,
আপনার ক্লাসের সাথে মেলে না তো স্যার।
তুমি ফের চুপসে গেলে তখন।
দুজনের শতবর্ষের পরের বছর আবার দেখা নার্সিংহোমে,
এখানে আইসিইউতে নারী-পুরুষ ভেদ নেই,
সেখানে একটু সেরে উঠতেই তুমি আবার প্রেমী হয়ে উঠলে—
যেন ঠিক শিশুকালের মতো।
তোমার বিয়ের আবদার শুনে নার্স সেলিনার সেকি হাসাহাসি,
তবু তুমি নাছোড়বান্দা—
কিন্তু এবার বাধ সাধল তোমার নাতনীর গ্র্যান্ড ডটর ডাক্তার,
সে বলল, ওল্ড ব্রো, সবই ঠিক আছে শুধু উনি আমাদের ক্লাসে যায় না।
তুমি এবারও চুপসে গেলে...
এর কিছুদিন পরে তুমি-আমি দুজনেই
পাশাপাশি কবরে,
সেই থেকে আমরা আছি কাছাকাছি,
সব ক্লাসের ঊর্ধ্বে।
তবে, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজের সাইনবোর্ডের পাশের
সেই Cascabela Thevetia গাছটা
আরও বড় এবং বেশ মোটা হয়েছে,
ওই গাছের তলা থেকে ফুল কুড়িয়ে
এখনো আমাদের মতো
মন-নিবেদন করে বহু শিক্ষার্থী।
তাদের ভালোবাসাও বয়ে চলে—
আমাদের মতো সমান্তরাল, নিরন্তর।
ঠিক যেমন তোমার-আমার ভালবাসা
বয়ে চলল নিরন্তর।