Logo

জীবনানন্দ

প্রবন্ধ

জীবন মৃত্যুর দর্শন : দূর হোক মৃত্যু ভয় জীবন হোক উপভোগ্য

জয় খ্রীষ্টফার বিশ্বাস

জয় খ্রীষ্টফার বিশ্বাস

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:১৯

জীবন মৃত্যুর দর্শন : দূর হোক মৃত্যু ভয় জীবন হোক উপভোগ্য

Death—Be Truly Life Oriented 

মৃত্যু—হয়ে উঠুক প্রকৃত জীবনমুখী। ধার্মীকগণ বলেন, যদি আপনি প্রতিনিয়ত মনে রাখেন যে আপনি মরণশীল, এই প্রথিবীর বুকে আপনি নম্রভাবে এবং সংবেদনশীল হয়ে হাঁটবেন।

একটা তাৎপর্যপূর্ণ জিনিস যা প্রত্যেকটি মানুষকে করতে হবে তা হলো তাদের মানসিক ও আবেগের কাঠামোকে জীবনের সবচেয়ে মৌলিক বাস্তবতা—তাদের মরণশীল প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা। যখন আপনি এটা করবেন একমাত্র তখনই সহজাতভাবে আপনি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া বা পার্থিব জগতের অতীত এক মাত্রার যোগ্য হয়ে উঠবেন। আপনার যুক্তিবাদী মনের প্রকৃতি এমনই যে এটা সবসময়ই আপনার চিন্তার গণ্ডি থেকে মৃত্যুকে সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলতে চাইবে। এই জন্যই বেশিরভাগ মানুষ নিজের মানসিক প্রক্রিয়া একটা অর্থহীন অমরত্বের ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন—যেন তারা চিরকাল থাকবেন। তাদের চিন্তাধারায় প্রতিদিন মনে করিয়ে দেওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই যে এটা একটা সীমিত পরিমাণ সময় এবং আপনি শুধুই আগের প্রজন্ম আর পরের প্রজন্মের মাঝখানের একজন বাহক মাত্র। এখন তো লোকজনের গোটা জীবনকালটাই লেগে যায় এটা উপলব্ধি করতে যে, তারা মরণশীল। তাদের এটা মনে করাতে একটা হার্ট অ্যাটাক বা কোথাও একটা ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বেরোনোর দরকার হয়।

মৃত্যু হলে যেকোনো একটি ঘটনা ঘটবে—আমরা চিরস্থায়ী ঘুমের মধ্যে চলে যাব, নয়তো শুরু হবে নতুন আরেকটি জীবন। মৃত্যু নিয়ে এই মূল্যবান ভাবনাটি গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের। সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করার কারণে । তিনি মৃত্যুকে হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন দেহটা ক্ষণিকের, আর মন অবিনশ্বর । মৃত্যুর পরে যদি নতুন আরেকটি জীবন শুরু হয় তাহলে সেখানে এই মনের দেখা পাওয়া যাবে। আর মৃত্যু যদি হয় চিরস্থায়ী ঘুম তাহলে তা হবে জীবন বা দেহের সমাপ্তি।

তিনি আরো বলেছিলেন, দেহের পিছনে বেশি সময় না দিয়ে অবিনশ্বর এই মনের দিকে বেশি সময় দেওয়া দরকার। তাহলে দৈহিক মৃত্যুকে আর ভীতিকর মনে হবে না।

আরো অনেক জ্ঞানী ও দার্শনিক ব্যক্তি এই বিষয়ে যে মতামত দিয়েছেন তাতে মৃত্যুকে পরিহার করার কথাই বলা হয়েছে। তাঁরা মনে করতেন মৃত্যু মানে দেহের সমাপ্তি, সকল অনুভূতির শেষ। মৃত্যু অবধারিত এবং অনিবার্য। মৃত্যু আমাদের হবেই। এটা চিরসত্য। তবুও আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। কেউ মৃত্যুকে হাসি মুখে মেনে নিতে পারি না। এর কারণ কী? দার্শনিকরা বলেন, মৃত্যুর ফলে কিছু হারানোর ভয় আমাদের মধ্যে কাজ করে। 

মৃত্যুর ফলে আমরা অনেক অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হব। জীবনে যা করতে পারতাম তা আমরা আর করতে পারব না। পৃথিবীতে সম্ভাব্য সব বিষয় বা বস্তুর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। জীবনকে উপভোগ করা থেকেও বঞ্চিত হব। যারা মৃত্যুকে ভয় পায় তারা এরকমভাবে।

জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তকে উদ্‌যাপন করে ও আনন্দের সাথে কাটানো দরকার কারণ এই হতচ্ছাড়া জীবনটা আপনার জন্য এক মুহূর্তের জন্যেও দাঁড়ায় না। যতক্ষণ দেহে শ্বাসপ্রশ্বাস আছে ততক্ষণ আপনি আর আমি। এর পরে সময়টা কিন্তু অতীত।  তাই যতক্ষণ প্রাণ আছে  জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উদ্‌যাপন করে ও আনন্দের সাথে কাটানো দরকার। এটা ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি এটাকে একটা আনন্দময় ও চমৎকার প্রক্রিয়া করে তৈরি করছেন। আপনি যদি অমর হতেন তাহলে আপনি ১০০ বছর করে বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, পাগলামো, দুঃখ, এগুলো সব উপভোগ করতে পারতেন আর তারপর ৫০০ বছর পূর্তিতে আপনি আনন্দ করতেন। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। আপনি মরণশীল এবং সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। যদি আপনি ভাবেন আপনি এখানে চিরকাল থাকবেন, আপনি জীবনকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে যাবেন, নিজের অর্থহীন সব মানসিক ঘুরপাকে জড়িয়ে থেকে—যার সাথে বাস্তব অস্তিত্বের আদতে কোন সম্পর্কই নেই। কিন্তু ধরুন আপনি যদি জানতেন আপনি পরবর্তী এক ঘণ্টায় মারা যাবেন, আপনি জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়েও খেয়াল করতেন। আপনি কিছুই বাদ দিতেন না। যদি এটাকে একটু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করতে যায়।

যদি আমরা আশি নব্বই বছর বাঁচি তাহলে জীবনকে উপভোগ করার জন্য যথেষ্ট সময় পাচ্ছি। এই সময়ে আমাদের পছন্দ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আমরা করতে পারি। তবে কেউ যদি পঁচিশ ত্রিশ বছর কিংবা কম বয়সে মারা যান তাহলে দুঃখবোধ হতে পারে। কারণ তিনি জীবনের পুরো সময়টা পেলেন না।

জীবন কারো দৃষ্টিতে সুন্দর, আবার কারো দৃষ্টিতে অসুন্দর/কুৎসিত। কারো কাছে বেদনার এবং অসহ্য। কেউবা নিজের জীবন নিয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে কার জীবনে কি ঘটেছে এবং সেসব বিষয়ে তার অনুভূতি কেমন তার উপর।

জীবনের মূল্য শুধু বেঁচে থাকার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনের মূল্য ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাগুলো এবং আমাদের অনুভূতির প্রকাশের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এইসব ঘটনা ও অনুভূতির সমাপ্তি ঘটে। এটি প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ঘটে আসছে, ভবিষ্যতেও তাই ঘটবে। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। বরং আমরা দৈহিক চাহিদার বিষয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে মনের অনুভূতিকে বেশি গুরুত্ব দিলে মৃত্যুভয় কমে আসবে।

এটা কোন মনখারাপ করা কথা নয়। এটা একটা জীবনমুখী বার্তা। আপনি প্রকৃতই জীবনমুখী হয়ে উঠবেন একমাত্র যখন জানবেন জীবন খুবই সীমিত একটা সময়। নিরাশা, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা বা রাগের জন্য কোনো সময় নেই। এই জীবনে কোনোরকম বিরক্তিভাবের জন্য সময় নেই।  বিরক্ত হওয়া ও বিষণ্ন থাকা হলো মৃত্যুমুখী হওয়া, তাই না? কেবল মাত্র নিজেকে অমর ভাবেন বলেই আপনি এইসবের জন্য সময় সুযোগ পান।

একমাত্র যদি আপনি জানেন যে আপনি মরণশীল—তবেই আপনি এই জীবনটা সত্যিকারের উপভোগ করবেন এবং আনন্দের সাথে জীবনে চলতে পারবেন। আপনার যদি প্রতিনিয়ত এটা মনে থাকে, তাহলে এই গোটা জীবন প্রক্রিয়াটা অর্থহীন মানসিক ঘুরপাক ও পার্থিব জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং সবকিছুকে উপলব্ধি করতে চাইবে। এটা চরম সজাগ হয়ে উঠবে। আপনার জীবন সহজাতভাবেই এসবকিছুর ঊর্ধ্বে কিছু খুঁজবে। আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া আপনার জন্য স্বাভাবিক উন্নতির এক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়াবে - জোর করে করার দরকার হবে না।

আরেকটি বিষয় ভাবুন। অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন বৃদ্ধ বয়সে, অক্ষম ও পরনির্ভরশীল অবস্থায়। প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক কষ্ট নিয়ে জীবনের শেষ সময় গুলো পার করেন। যাঁরা এমন মানুষকে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা অনুভব করেছেন তাঁদের এই যন্ত্রণা। এইসব মানুষের মৃত্যুতেও স্বাভাবিক ভাবে আমরা ব্যথিত হই। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর ফলে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটে। তাই আপনজনের এই ধরনের মৃত্যুতে আমাদের ভীত না হয়ে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াই উত্তম।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, মৃত্যুর পরে আরেকটি নতুন জীবন শুরু হবে। সেই জীবন হবে অনন্তকালের। কেমন থাকব আমরা সেই জীবনে? এই বিষয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। আমরা জীবনের অন্যান্য অর্জনের পাশাপাশি পরকালের জন্য ভাল প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারি, যেন সেই অন্তত জীবন আমাদের কাছে উপভোগ্য হয়। এক্ষেত্রে মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার তো কোন কারণ নেই।

জীবন বৈচিত্র্যময়। এর শেষ মানে সকল বৈচিত্র্যতার সমাপ্তি। কিন্তু যেটুকু সময় আমরা পাচ্ছি তার সদ্ব্যব্যবহার করে জীবনকে পরিপূর্ণ উপভোগ করাই হচ্ছে জীবনের সার্থকতা।

জীবনটা আপনার। কীভাবে এই জীবনকে ব্যয় করবেন তা আপনি নিজেই নির্ধারণ করতে পারেন। এটি সুখের হতে পারে, বেদনার হতে পারে। অথবা এটি হতে পারে শুধুই বেঁচে থাকা।

জীবনকে আপনি যে দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করবেন, জীবন ঠিক সেরকমই মনে হবে আপনার কাছে। জীবনকে আপনি পাবেন সেরকমভাবেই। তাই জীবন সম্পর্কে ভাবনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে জীবনকে উপভোগ করার উপায় খুঁজতে হবে আমাদের। জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে আফসোস না করে মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে হবে। জীবনে এমন কাজ আমাদের করা দরকার যেন মৃত্যুর মুখোমুখি হলে আফসোস করতে না হয়। দূর হোক মৃত্যুভয় এবং জীবন হোক উপভোগ্য। 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর