
শেষ বিকেল। পশ্চিমাকাশের সূর্যটা ডিমের কুসুমের মতো গোলাকার।
দুপুরের তেজোদীপ্ততা হারিয়ে সে এখন নিস্তেজ।
কাপড়চোপড় ভর্তি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছে একজন তরুণী। সে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছে ; কিন্তু গাড়ির দেখা নেই।
হঠাৎ একটা খালি রিকশা দেখা গেলো।
রিকশাটা বেশ জোরে চলছে। তরুণী হাত উঁচিয়ে রিকশার গতি থামিয়ে দিয়ে বলল,
- আঙ্কেল ! আছমত আলি মার্কেট যাবেন ? রিকশাওয়ালা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। তরুণীটার বয়স পঁচিশ কি বা ছাব্বিশ হবে। সে জেনারেল পড়ুয়া হলেও ধার্মিক।
পরনের পোশাক-আশাক থেকেই তা অনুমান করা যাচ্ছে।
তার গায়ে ঢিলেঢালা বোরকা। হাতে পায়ে মৌজা।
তার সাথে রয়েছে ছোট্ট দুটি বাচ্চা। একটি ছেলে শিশু আর একটি মেয়ে শিশু। ছেলেটার বয়স চার বছর
আর কোলে থাকা মেয়েটার বয়স সম্ভবত এক বছর হবে। রিকশাওয়ালা ও তরুণী দুজন একই এলাকার । তরুণী তাঁকে আঙ্কেল বলে ডাকে আর তিনি ওকে মা বলে সম্বোধন করেন।
রিকশা ছুটে চলেছে গন্তব্য পানে ।
রিকশাওয়ালা বললেন, মা,বাচ্চারারে ধইরাটইরা রাখিস ?
তরুণী বললো, ওকে!
এরপর দু'জনের মাঝে শুরু হলো,সুখ-দুঃখের কথা।
পারিবারিক আলোচনা।
- আহ! যেদিন আমার চাচীটা মারা গেছে ওই দিন আপনার ওয়াইফটাও মারা গেছে ।
আচ্ছা, আঙ্কেল! আপনি এখন কার সাথে খাবার খান?
- পুতের বউ এর লগে।
- এরা ঠিক মতো আপনার খবর-টবর রাখেনি?
- রাহে মা, রাহে ।
- আপনার সেবা-যত্ন করে নি?
রিকশাওয়ালা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, মা! আসল মানুষডা চইল্লা গেলে কি হয় তা তো জানই!
এই বেলার খানা হেই বেলা খাই। সারাদিন গাড়ি চালাইয়্যা বাড়িত গিয়া নিজের ময়লা কাপড়চোপড় নিজেই ধুইতে অয়। তিনি কথাগুলো বলছেন আর দরদর করে দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তাঁর । বারবার তিনি গলায় পেঁচানো গামছাটা দিয়ে চোখের পানি মুছছেন। রিকশাটা অবিরাম খটখট শব্দ করছে। মনে হয় এর কিছু একটা নষ্ট হয়ে গেছে।
- আঙ্কেল, কান্না কইরেন না। আল্লাহ সবকিছু ব্যবস্থা করবেন।
- দোয়া কইরো মা!
- জ্বি, আমার জন্যও দোয়া চাই।
- আল্লাহ তোমারে সুখে রাহুক। এমন বিপদে জীবনে না ফেলুক ।
লোকটা দরিদ্র বটে। তবে তিনি একজন সৌখিন ও খেলাপ্রেমী মানুষ। বয়স পঞ্চাশের কোটায়। তবুও তিনি ফুটবল খেলেন। ফুটবল তার প্রিয় খেলা। এক সময় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে খেলতেন। আর এখন খেলেন শখ করে ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে।
এ বয়সে তাকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নেবেই বা কারা! ছোটবেলা থেকেই তিনি লম্বা লম্বা চুল রাখেন। চুলগুলো সব সময় সিঁথি করে রাখেন এবং তাতে সুগন্ধি তেল ব্যবহার করেন।
শুধু চুলের যত্নের জন্য তিনি নানা পদের তেলের বোতল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন তার শোকেসটাকে। শোকেসটাকে ছোটখাটো একটা দোকান বললে ভুল হবে না।
আগে তার মাথার চুলগুলো কুচকুচে কালো ও ঝরঝরে ছিল; কিন্তু এখন অর্ধেক চুল সাদা হয়ে গেছে। তিনি সবসময় গলায় একটা লাল গামছা ঝুলিয়ে রাখেন। কেউ কেউ আবার লালকে সফলতার প্রতীক মনে করে। সেই জন্যই নাকি না অন্য কোনো কারণে লাল গামছাটা তিনি ব্যবহার করেন। কে জানে! হলেও হতে পারে। মাঝে মাঝে তার মাথায় তালের আঁশের একটা টুপি দেখা যায়। আজ অবশ্য মাথায় সেই টুপিটা নেই। এই টুপিটা নাকি কালিয়াপুরের পীরের মুরিদরা পরিধান করে থাকে। লোকমুখে শোনা যায়! তিনি যখন নতুন ঘর নির্মাণ করেছিলেন তখন কালিয়াপুরের গদ্দিনশিন পীর সাহেবকে ওই নতুন ঘর উদ্বোধনের জন্য দাওয়াত করেছিলেন। আর সেই অনুষ্ঠানে পীরের সঙ্গে তার ভক্তবৃন্দ-কাওয়ালী পার্টি ও এসেছিল। সেদিন ঘরের বেড়া খুলে নাকি মুরিদরা গান গেয়েছিল। নৃত্য করেছিল। আর এতে পাড়ার শিশু- নারীরা অব্দি জমায়েত হয়ে তাদের তামাশা দেখেছিল। আজও প্রবীণদের মুখে মুখে সে ঘটনা শোনা যায়।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও প্রবন্ধকার
- বাংলাদেশের খবরের জীবনানন্দ (সাহিত্য) বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bksahitya247@gmail.com