জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
জীবনানন্দ দাশ : বাংলার শুদ্ধতম কবি তিনি এক
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩:৪৬
-67b3796686097.jpg)
জীবনানন্দ দাশ—বাংলা কবিতার এক নিভৃতচারী সাধক, অনন্য প্রতিভা। তাঁর কবিতার ভাষা, অনুভূতি, আর চিত্রকল্প বাংলা কবিতার এক নতুন স্বরূপ নির্মাণ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলা কবিতায় সর্বাধিক উচ্চারিত নাম সম্ভবত জীবনানন্দ দাশ। তবে তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো আলোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন না, নজরুলের মতো উচ্চস্বরও নন, বরং যেন নিভৃত জ্যোতির্ময় এক কবি, যাঁর কবিতায় একাধারে ধরা পড়ে পরাবস্তবতা আর বাস্তবতার মিশেল। তিনি এমন এক কবি, যিনি শব্দের অতলান্ত সাগরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন শুদ্ধতম কবিতার মুক্তো।
তাঁকে বলা হয় বাংলা কবিতার ‘শুদ্ধতম কবি’। তাঁর কাব্যে যেন জীবনের সত্য সব অনুভূতির প্রকাশিত হয়ে ওঠে নিবিঢ় গভীরভাবে। অনন্য চিত্রকল্প আর নিভৃত নির্জনতার মধ্য দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক আলাদা জগৎ, নিজস্ব স্বর। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি আছে, তবে তা নিছক প্রকৃতির রূপ নয়; বরং প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক, যেখানে জীবন, মৃত্যু, ভালোবাসা, বিরহ, সব একাকার হয়ে যায়। তাঁর ‘বনলতা সেন’, ‘আবার আসিব ফিরে’, ‘রূপসী বাংলা’ কিংবা ‘মাল্যবান’—সবই একেকটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন যেন। পাঠকের মনের অন্দরে ঠাঁই করে নেয় আপনাআপনি। আর হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ।
জীবনানন্দের কবিতা যেন এক অদ্ভুত মায়ার জাল। তাঁর কবিতার প্রকৃতি শান্ত, নির্জন, গভীর। তাঁর কবিতার পটভূমি কখনও সবুজ বাংলার মেঠোপথ, কখনও নিঃসঙ্গ কোনো শহরের অন্ধকার গলি। নগরজীবন ও গ্রামীণ জীবনের এক মিশ্র অনুভূতি তাঁর লেখায় ধরা পড়ে। ‘রূপসী বাংলা’-তে তিনি বাংলার রূপকে তুলে ধরেছেন এমন এক গভীরতায়, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
তাঁর ব্যক্তিজীবন ছিল নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি। লাবণ্য দাশের সঙ্গে দাম্পত্য জীবন ছিল জটিল ও টানাপোড়েনের। প্রেম, বিরহ, দ্বন্দ্ব—এসব মিলিয়ে তাঁর জীবন ছিল এক অনিশ্চিত যাত্রার মতো। এই নিঃসঙ্গতাই তাঁকে আরও গভীরভাবে কবিতার দিকে ঠেলে দেয়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘মাল্যবান’-এ আমরা দেখতে পাই সেই দ্বন্দ্ব, সেই একাকীত্বের প্রতিচ্ছবি।
জীবদ্দশায় তিনি খুব একটা স্বীকৃতি পাননি। তাঁর কবিতার জটিলতা, গভীরতা এবং এক ধরনের বিমূর্ততা সমসাময়িক পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য ছিল না। অনেকেই তাঁকে কঠিন মনে করতেন। তাই সেকালে অনেক সমালোচকও তাঁকে উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু সময় বদলেছে, বাংলা কবিতা জীবনানন্দের মর্ম বুঝতে শিখেছে। আজ তাঁর কবিতা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদের মধ্যে অন্যতম।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু যেমন তাঁর জীবনের মতোই এক রহস্যময় অধ্যায়। ১৯৫৪ সালে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি মারা যান। কেউ কেউ মনে করেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা ছিল না, বরং তাঁর অবচেতন মনে মৃত্যু যেন এক আকাঙ্ক্ষিত পরিণতি। কারণ তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছিল মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা আর অন্তহীন যাত্রার কথা। কবিতার মতোই তাঁর জীবনও ছিল ধূসর বিষাদে মোড়ানো, যেখানে আনন্দের চেয়ে বিষণ্নতাই বেশি দানা বেঁধেছিল।
তবে জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাননি। আজ তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নন, তিনি হয়ে উঠেছেন কবিতার এক নির্জন দার্শনিক। তাঁর কবিতা সময়ের সীমানা অতিক্রম করে এক চিরকালীন অনুভূতি হয়ে উঠেছে। বাংলার শুদ্ধতম কবি তিনি এক—যিনি শব্দের নিভৃত সাধক, যাঁর কবিতায় সময়ের কোনো গণ্ডি নেই, আছে শুধু অনুভূতির অনন্ত প্রবাহ।
১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মেছিলেন। জন্মদিনে শুদ্ধতম কবির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।