চারণ সাংবাদিকতার অমর দৃষ্টান্ত মোনাজাতউদ্দিন
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০
-67704ab8b3d03.jpg)
আজ থেকে ২৯ বছর আগে, ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর রংপুরের খ্যাতনামা চারণ সাংবাদিক, অনুসন্ধানী প্রতিবেদক মোনাজাতউদ্দিন পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন।
তার মৃত্যু আজও একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন রেখে যায়—তিনি কি সত্যিই পা পিছলে যমুনা নদীতে পড়ে যান, নাকি তার মৃত্যুর পেছনে ছিল অন্য কোনো ষড়যন্ত্র?
মৃত্যুর পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি।
মোনাজাতউদ্দিনের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে উত্তরাঞ্চলে সাংবাদিকতা করে। তিনি ছিলেন একজন চারণ সাংবাদিক। যিনি পথঘাট, গ্রাম-গঞ্জের কোণে কোণে ঘুরে সত্যের সন্ধান করেছেন।
তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মানুষের অবস্থা, জীবনের বাস্তবতা। তার প্রতিটি প্রতিবেদন ছিল যেন এক জাগরিত সমাজের জীবন্ত চিত্র। তার লেখনীর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মানুষের কষ্ট, সংগ্রাম এবং তাদের জীবনযাত্রা উঠে এসেছে।
১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোনাজাতউদ্দিন। তার বাবা মৌলভী আলীম উদ্দীন আহমেদ ও মা মতিজান নেছা।
তার শৈশব ও কৈশোরের সময় ছিল অত্যন্ত কষ্টের। বাবা হারানোর পর সংসারের হাল ধরতে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। তার জীবনের প্রতি পদে ছিল অদম্য এক সাহসিকতা ও সত্যের প্রতি অটুট নিষ্ঠা।
তার শিক্ষাজীবনও ছিল সংগ্রামী। তিনি কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করার পর, রাজশাহী বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে, কারমাইকেল কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করেন। তবে তার জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে যখন বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময় তার বাবা মারা যান। এর ফলে তাকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। যা তার পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটায়। তবে একসময় তিনি প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাস করেন।
তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি নাটক, কবিতা, ছড়া, গল্প লেখার মাধ্যমেও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন মোনাজাতউদ্দিন। এরপর ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক রংপুর’ প্রকাশ করে নিজেকে একজন সক্রিয় সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদে যোগ দেওয়ার পর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সংবাদ ছেড়ে জনকণ্ঠ পত্রিকায় যোগদান করেন।
তার সেরা কাজ ছিল ‘পথ থেকে পথে’ শীর্ষক ধারাবাহিক রিপোর্ট। বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতায় একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ছিল এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন।
মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা ছিল তার জীবনের অঙ্গ। তার কাজের মধ্যে ছিল গ্রাম-বাংলার জীবন, কৃষকের কষ্ট, বন্যার ক্ষতি ও সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা।
তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে, যা দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখায় তাকে ১৯৯৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ প্রতিবেদনের জন্য তিনি ফিলিপস পুরস্কার পান। ছাড়া সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৪ সালে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন।
মোনাজাতউদ্দিনের লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘সংবাদের নেপথ্য’, ‘পথ থেকে পথে’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘শাহ আলম ও মজিবের কাহিনি’ এবং ‘কাগজের মানুষ’। এসব বইয়ে শুধু খবরই নয়, মানুষের জীবনযাত্রা, সমাজের সমস্যা ও অবহেলিত জনগণের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন।
মোনাজাতউদ্দিন শুধু সাংবাদিক নন, তিনি ছিলেন নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিকতা শুধু খবর জানানো নয়, সমাজের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করা- মোনাজাতউদ্দিন তার জীবনে তা প্রমাণ করেছেন।
আজকের দিনে যখন সাংবাদিকতা প্রায়শই শহুরে দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত, তখন মোনাজাতউদ্দিনের জীবন ও কর্ম মনে করিয়ে দেয়- সাংবাদিকতা যখন জনগণের পক্ষে থাকে, তখন তা কতটা শক্তিশালী হতে পারে।
- আতাউর রহমান সোহাগ : কান্ট্রি এডিটর, বাংলাদেশের খবর
এআরএস/এমএইচএস/এইচকে