
বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটা /ছবি : সংগৃহীত
দেশে সাড়ে আট হাজারের বেশি ইটভাটা চালু রয়েছে। বেশিরভাগ ভাটা চলছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই। পরিবেশ ও বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস এসব ইটভাটার প্রধান উপাদান কৃষিজমির টপ সয়েল বা উর্বর মাটি। আর অনেক ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে নিম্নমানের কয়লা ও কাঠ। যার ফলে পরিবেশ দূষণ বেড়েছে বহু গুণ।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে আট হাজার ইটভাটা চালাতে বছরে ১৪ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি মাটির প্রয়োজন। আর ইট প্রস্তুতের জন্য প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ টন কাঠ পোড়ানো হয়, যা বন ধ্বংস এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে।
এসব মাটি সংগ্রহ নিয়ে আবার এলাকাভেদে জমি দখলের ঘটনাও ঘটছে। অবৈধ ইটভাটা এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে। অবৈধ এসব ইটভাটা দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি ও জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিগত কয়েক বছরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে বহু অবৈধ ইটভাটা। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জন্য এখন এসব আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাগীয় দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পকেট ভারি করার অন্যতম মাধ্যম এসব অবৈধ ইটভাটা। যে কারণে অবৈধ এসব ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
খোদ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টার নির্দেশনাও আমলে নিচ্ছে না অধিদপ্তর। উচ্চ আদালতকেও সরাসরি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। অতীতে রাজনৈতিক প্রভাবের দোহাই দিলেও এখন ঘুষ বাণিজ্যের কারণে বন্ধ হচ্ছে না এসব ইটভাটা।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের অবৈধ সব ইটভাটা চার সপ্তাহের মধ্যে গুঁড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পরিবেশে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সকল বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে (ডিসি) এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করে আগামী ১৭ মার্চ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং পাঁচজন বিভাগীয় কমিশনারকে আগামী ১৭ মার্চ সশরীরে হাজির থেকে ব্যাখ্যা দিতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, জবাব দিতে সশরীরে হাইকোর্টে হাজির হলেও অবৈধ ইটভাটা স্থায়ীভাবে বন্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তর?
এর আগে, গত বছরের ডিসেম্বরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টার দপ্তরে সুনির্দিষ্ট অবৈধ তিনটি ইটভাটা বন্ধের আবেদন করেন ঝালকাঠির এবিএম জাহিদুল ইসলাম।
আবেদনে বলা হয়, নলছিটি পৌরসভার ৭ ও ৮নং ওয়ার্ডে (এমএম ব্রিক্সস, রিয়াজ ব্রিক্সস ও এসআরবি ব্রিক্সস) তিনটি অবৈধ ইটভাটা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ভাটাগুলো ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ অমান্য করেই পরিচালিত হচ্ছে। ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ফসলি জমির মাটি জবরদখল করে ভেকু দিয়ে কেটে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। ভাটা মালিকদের পোষা বাহিনীর ভয়েও তটস্থ স্থানীয়রা। এসবই ঘটছে বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অফিসের ছত্রছায়ায়। বিনিময়ে ভাটাপ্রতি ২ লাখ টাকা উৎকোচ নিচ্ছেন পরিবেশ কর্মকর্তা- এমন অভিযোগও উল্লেখ করা হয়েছে।
আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে অভিযানে যান, তবে তা কেবলই লোক দেখানো। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই-বাছাই শেষে অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দেয় উপদেষ্টার দপ্তর। অথচ নির্দেশনার ২০ দিন পরও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি অধিদপ্তর।
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মু. সোহরাব আলিকেও একাধিকবার ফোন ও মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ফলে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কারোর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলাতেই চলছে অবৈধ ইটভাটা। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, লালমাইসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও একই অবস্থা। ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় খানাখন্দে ভরে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ আমলে গড়ে উঠা এসব ভাটায় ইট তৈরির জন্য ফসলি জমির মাটিই নেওয়া হতো। কুমিল্লায় পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ডাকাতিয়া নদী খননের পর যে মাটির বাঁধ ছিল সেটিও কেটে নেয় ভূমিদস্যুরা। নদী পাড়ের সেই মাটি নেওয়া হয় ইটভাটায়। ফলে গত বছরের আগস্টে ভয়াবহ বন্যায় ডাকাতিয়া নদীর পাড় ভেঙে প্লাবিত হয় দক্ষিণ কুমিল্লার বৃহৎ জনপদ। ওই সময় ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরও পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা রাখেনি।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়েও একই অবস্থা। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে সেখানে কৃষি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছে প্রভাবশালী মহল। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভয়ভীতি দেখিয়ে ৪০ থেকে ৫০ ফুট গর্ত করে ইটভাটায় মাটি নিয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। ওই এলাকায়ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছত্রছায়ায় যত্রতত্র গড়ে উঠা ইটভাটায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। কাটা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। আর এসবের কালো ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবীর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সারাদেশের ইটভাটা বেশিরভাগই অবৈধ। এগুলোর অনুমতি দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। তারা অতীতেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব করেছিল। কিন্তু এখন তো রাজনৈতিক সেই প্রেক্ষাপট নেই- তাহলে কেন এখন বন্ধ করতে পারছে না এসব। যেখানে উপদেষ্টা নিজেই জরিমানা করছেন, বন্ধ করেছেন আমরা দেখেছি। বন্ধ না হওয়ার পেছনে প্রশাসনের ছত্রছায়া রয়েছে- বলেন তিনি।
প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের ঘুষ দিয়েই এসব ইটভাটা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শত শত অভিযোগ পড়ে রয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ থাকার পরও প্রশাসন এসব বন্ধের বিষয়ে নীরব। আমরা তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। যেসব কর্মকর্তারা এখনো এসব বন্ধে কাজ করছে না তাদের ক্লোজড করতে হবে। ওএসডি করে তাদের স্থলে অন্য কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে। অন্যথায় এসব বন্ধ হবে না।
অবৈধ ইটভাটা বন্ধে জনবল ও ম্যাজিস্ট্রেট সংকটসহ একাধিক প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সাভার, আশুলিয়া, নোয়াখালীর রামগতি, চট্টগ্রাম ছাড়াও আরও বেশকটি এলাকায় ৫১টি ইটভাটা আসন্ন মৌসুমে আমরা বন্ধ করব। অবৈধ ভাটা বন্ধে ইতোমধ্যে রামগতিতে তিনবার লোকও পাঠিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ১২ হাজার ইটভাটা ভাঙার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিকল্প হিসেবে ব্লকও এখনো আসেনি। আমরা বোর্ড অব রেভিনিউর সঙ্গে বসছি, কথা বলছি।
উপদেষ্টা বলেন, মানুষ এখন এসব নিয়ে অভিযোগও করছে। যদিও বিকল্প নেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বর্তমান কার্যক্রমের বিষয়েও আপনারা জানেন। তারপরও আমরা এসব নিয়ে কাজ করব। সামনের মৌসুমে ১৫ শতাংশ ইটভাটা কমানো উদ্যোগ নিয়েছি।
- এনএমএম/ওএফ