Logo

জাতীয়

পাঠ্যক্রমে সংবিধানের দাবি

জয় খ্রীষ্টফার বিশ্বাস

জয় খ্রীষ্টফার বিশ্বাস

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১৭:৪৬

পাঠ্যক্রমে সংবিধানের দাবি

সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের নিয়মের বই, যেটি বলে- রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, কোন কোন প্রতিষ্ঠান থাকবে (যেমন : সংসদ, সরকার, আদালত), সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা কতটুকু, নাগরিক হিসেবে একজনের অধিকার কী এবং তিনি কী কী দায়িত্ব পালন করবেন।

এটি দেশের আইনের ভিত্তি। সংবিধান নাগরিকের অধিকার রক্ষা করে এবং রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ের পথে পরিচালনা করে। তাই সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদেরকে সংবিধান সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া জরুরি। এরই প্রেক্ষিতে পাঠ্যক্রমে আবশ্যিকভাবে সংবিধান অন্তর্ভুক্ত করার দাবি অনেকের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থী, সমাজসেবক ও অনেক রাজনীতিবীদ মনে করছেন, স্কুল-কলেজে সংবিধান পাঠ্য হিসেবে আবশ্যিক করলে তা সচেতন ও সুনাগরিক গড়তে সহায়ক হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘সংবিধান পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হলে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের কাঠামো, আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারবে। এটি তাদেরকে সক্রিয় ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।’ এ ছাড়া সংবিধানের বিধানগুলো সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁছে দিতেও পরামর্শ দেন তিনি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা আমিরুল ইসলাম কনক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সংবিধান নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত। স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে সংবিধানের মৌলিক ধারণা থাকা দরকার। আমি মনে করি, স্কুল-কলেজে সংবিধানের ধারণা দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা যেমন অধিকার সম্পর্কে জানবে, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবে। অপরদিকে যদি কেউ আইনের অপব্যবহার করে ভিতি সঞ্চার করে বা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে নাগরিক নিজেকে আর দুর্বল মনে না করে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধান শুধু আইনবিদদের জন্য নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের জানার বিষয়। পাঠক্রমে সংবিধান অন্তর্ভুক্ত করা হলে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিক সচেতনতা গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।’

শিক্ষাবিদরা বলছেন, সংবিধান পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশের আইন, নীতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হবে। এতে করে তারা একটি সুশৃঙ্খল, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। গবেষকরা মনে করছেন, সংবিধান সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।

শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সংবিধান পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা প্রয়োজন উল্লেখ করে তারা বলছেন, প্রাথমিক স্তরে সংবিধানের সাধারণ নীতি, মাধ্যমিক স্তরে নাগরিকের অধিকার ও দায়িত্ব এবং উচ্চ মাধ্যমিক-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সংবিধানের আইনগত ও রাজনৈতিক দিকগুলো শেখানো যেতে পারে।

এ ছাড়া ধারাবাহিকভাবে বিষয়ভিত্তিক প্রকাশনা করে বা চটি বই আকারে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ বাজারে আনলে সকল স্তরের নাগরিক এটি পড়ে রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে সচেতন হবে। এতে নাগরিকের সঙ্গে আইনের যে ভুল প্রয়োগ নানা সময় দেখা যায়, সেটি আর হবে না।

তবে সংবিধান পাঠ্যক্রমে আনার বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম বললেন ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, ‘সংবিধান প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারবে না। আর তাদেরকে বুঝিয়ে পড়ানোর মতো সক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষকও নেই।’

সংবিধান নিয়ে ডিগ্রি বা অনার্সের শিক্ষার্থীদের ১০০ মার্কের কোর্স থাকতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এজন্য ইউজিসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের কারিকুলামে এটা যুক্ত করার উদ্যোগও নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও সংবিধান বুঝিয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষকের সংকট রয়েছে।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও আলোচনা আছে সংবিধানকে পাঠ্য করার বিষয়ে। সংস্কৃতিকর্মী আরিফ নূর বলেন, ‘সংবিধানকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এটি প্রচার ও প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। তাহলেই জনমুখী হবে।’ 

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জমসেদ আনোয়ার তপন বলেন, ‘সংবিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও বোঝাপড়া গড়ে তুলতে একে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্য করার বিকল্প নেই। এটি নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সাংবিধানিক মূল্যবোধ জাগ্রত করবে। বিষয়টি বিবেচনায় এনে বাস্তবায়ন করা এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সময়ের দাবি।’

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংস্কারের দাবি উঠেছে। রাজনৈতিক অনেক দল বলছে, এই সংবিধানে এমন উপাদান রয়েছে যা ফ্যাসিস্ট তৈরি করতে পারে। তাই সংবিধান সংস্কার করে গণমুখী করতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছে তার মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্যতম। ইতোমধ্যে এ কমিশন সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

সংবিধান নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলামকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি জুলাই ‘ম্যাগনা কার্টা’ (রাজার ক্ষমতা খর্ব করার দলিল) প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। যেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। সকল রাজনৈতিক দলকে এই ম্যাগনা কার্টা মেনে রাজনীতি করতে হবে।’

এদিকে, সংবিধানকে যখন পাঠ্য করার আলাপ চলছে, তখন স্বাধীনতার এত বছরেও পাঠ্যক্রমে ‘আদিবাসীদের’ নিজস্ব ভাষা অন্তর্ভুক্ত না হওয়া নিয়ে আক্ষেপ জানালেন রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক হরেন্দ্র নাথ শিং। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, ‘পাঠ্যক্রমে আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সংবিধানে স্পষ্ট করে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে হবে।’ সংবিধানে যেন আদিবাসীদের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়, সেটির জোর দাবি জানান হরেন্দ্র নাথ শিং। 

জেসি/এইচকে

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর