Logo

জাতীয়

ঈদের রাতে কী ঘটেছিল কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কে?

নুর মোহাম্মদ মিঠু

নুর মোহাম্মদ মিঠু

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:৩৭

ঈদের রাতে কী ঘটেছিল কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কে?

‘হাতে নেই অস্ত্র, মুখে নেই মুখোশ, নেই ডাকাতির অন্য কোনো আলামতও। এ কেমন ডাকাত দল!’ গেল ঈদুল ফিতরের দিন রাতে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে ঘটে যাওয়া ঘটনায় এমন প্রশ্নই দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে। 

ঘটনার ভিডিও ভাইরালের পর গণমাধ্যমেও বলা হয় ‘ডাকাতদল’। ফেসবুকেও ডাকাত আখ্যা দিয়ে করা হয় পোস্ট, শেয়ার ও কমেন্টস। অথচ পুলিশের তদন্ত আর বাংলাদেশের খবরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। 

জুলাই-আগস্টের পরে দু-একটি ঘটনা ঘটলেও পুলিশি তৎপরতায় গেল ঈদে একটিও ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। একইভাবে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কেও বিগত ৫ বছরে ডাকাতির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ, মহাসড়ক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে। তারা জানান, ঈদের দিন রাতের ঘটনাটিও ডাকাতির ঘটনা ছিল না।

বাংলাদেশের খবরের অনুসন্ধানে ওই রাতের ঘটনার দুটি কারণ জানা গেছে। একটি মোটরসাইকেল আরোহীদের সাইড দেওয়াকে কেন্দ্র করে, অপরটি ওভারটেকিং করতে গিয়ে চাপ দেওয়াকে কেন্দ্র করে। দুই কারণে বাসচালকের বেপরোয়াভাব ফুটে উঠলেও মিডিয়া ট্রায়ালে ডাকাতের হাত থেকে যাত্রীদের রক্ষা করে তিনি বনে গেছেন হিরো। আর ঘুরতে বের হওয়া মোটরসাইকেল আরোহীদের বানিয়েছেন ‘ডাকাত’। যাত্রীদের প্রাণ রক্ষা করেছেন জানিয়ে সেই চালক এখন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

নোয়াখালী জেলা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, জোনাকী পরিবহনের একটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীদের চাপ দেয় একুশে পরিবহনের ওই বাস। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাস থামাতে বলেন মোটরসাইকেল আরোহীরা। বাসের চালক না দাঁড়িয়ে উলটো বাসের গতি বাড়িয়ে দেন। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওই যুবকেরা বিভিন্নভাবে বাসটিকে থামানোর চেষ্টা করে। 

একপর্যায়ে তাদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে আহতও হন বাসচালক। তবুও না দাঁড়িয়ে নোয়াখালীর দিকে ছুটতে থাকে বাসটি। যুবকরাও বাসটিকেও ধরতে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত ধাওয়া করেন। এরই মধ্যে আতঙ্কিত যাত্রীরা মোটরসাইকেল আরোহীদের ভিডিও ধারণের পাশাপাশি ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান। 

পুলিশও সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা এলাকায় পৌঁছালে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মোটরসাইকেল আরোহীরা চৌরাস্তা হতে ঘুরিয়ে দ্রুত বেগে সোনাইমুড়ী-লাকসাম রোডে চলে যায়। একই সময় বাসটিকেও ওই স্থানে আর পায়নি পুলিশ।

এদিকে, কুমিল্লা জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মূলত সাইড দেওয়াকে কেন্দ্র করেই বাসচালক ও মোটরসাইকেল আরোহীদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। যাত্রীরাও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডাকাত ডাকাত করে চিৎকার শুরু করে।

কুমিল্লা জেলা পুলিশ বলছে, ‘ঘটনাটি নোয়াখালী এলাকার। তবুও আমাদের সার্কেল এসপি সেদিন তাৎক্ষণিক তৎপরতা দেখিয়েছেন। তবে তদন্ত করছে নোয়াখালী জেলা পুলিশ।’

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) রাশেদুল হক চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জুলাই-আগস্টের পর অবনতি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে ডাকাতির কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে সেটা কম। আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ সব ক’টি আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতদিন টহল কার্যক্রম জোরদার রেখেছি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রাতে ৮টি, দিনে ৬টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করে।

হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার খাইরুল আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘দাউদকান্দি থেকেই আমাদের টহল টিম দায়িত্ব পালন করে। সেদিন ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। কুমিল্লা থেকে নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে বিগত ৫ বছরেও ডাকাতির কোনো ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন বাজার কমিটির সভাপতিদের সঙ্গে কথা বলেছে হাইওয়ে পুলিশ। তারা পুলিশকে জানিয়েছেন, সে দিনের ঘটনাটিও ডাকাতির ঘটনা ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, লাকসাম বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও কথা বলে পুলিশ। তারাও জানিয়েছেন, সেদিন ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। লাকসাম হাইওয়ে থানার ওসি, চন্দ্রগঞ্জ থানার ওসি ও কুমিল্লা রিজিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ঘটনাটি তদন্ত করেছেন। আমি নিজেও পরিদর্শন করেছি। মহাসড়কের দোকানদাররাও জানিয়েছেন ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়াও ওই ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীদের কাছে ছুরি, চাপাতি বা কোনোরকম অস্ত্রও ছিল না। ডাকাতির আলামত কিছুই ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ মুখোশধারীও ছিল না। 

ব্যবসায়ীসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ঈদের দিন আনন্দ করতে ঘুরতে বের হন তারা। তারাও নোয়াখালীর দিকেই যাচ্ছিলেন। একুশে পরিবহনের ওই চালকের কাছে সাইড চান। চালক সাইড দেননি। থামাতে গিয়ে তাদের মধ্যে গতির প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত ধাওয়া করেও বাস থামাতে পারেননি তারা।

হাইওয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘এর মধ্যে এক থেকে দেড়শ গাড়ি গেছে ওই রোডে। তাদের সাথে তো এমন ঘটনা ঘটেনি।’ 

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরপরও ওই বাসের চালক চাইলে সুধারাম থানায় জিডি করতে পারেন। কারণ ওনার গাড়িতে ইট নিক্ষেপ করে আঘাত করা হয়েছে। এ জন্য জিডি করতে পারেন। আইনি প্রতিকার পেতে পারেন।’

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিয়ার) ইনামুল হক সাগর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সেদিনের ঘটনাটি ডাকাতি ছিল না। পুলিশের তদন্তে এখন পর্যন্ত ডাকাতির কোনো আলামতও মেলেনি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মিডিয়াতে ঘটনাটিকে ডাকাতি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে।’ 

মোটরসাইকেল আরোহীদের কাউকে পাওয়া গেছে কি না, তাদের বক্তব্য জানা গেছে কি না এবং এ ঘটনায় পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নোয়াখালীর পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

গত ৩১ মার্চ গভীর রাতের ওই ঘটনাকে বাস ডাকাতির চেষ্টা শিরোনামে বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদ প্রচার ও পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল ফারুক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ঘটনাটি আসলে ডাকাতি ছিল না। একুশে পরিবহনের ওই চালক অপর একটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীকে চাপ দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার সাথে থাকা অন্য আরোহীরাও বাসটিকে দাঁড়াতে বললে চালক থামেনি। ফলে আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তারা। একপর্যায়ে তাদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে চালক আহত হয়।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি কুমিল্লায় ঘটেছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এখনো মোটরসাইকেল আরোহীদের পাওয়া যায়নি। তাদের পাওয়া গেলে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে জানাতে পারব। তবে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে প্রচার হয়েছে, ঘটনাটি সেরকম নয়।’

এনএমএম/এমজে/এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর