Logo

জাতীয়

স্বেচ্ছায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সারেন্ডার

Icon

তরিকুল ইসলাম সুমন

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৪

স্বেচ্ছায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সারেন্ডার

আওয়ামী শাসনামলে প্রায় ৬০ হাজার জনের চাকরি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। চাকরিপ্রাপ্তদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ তৈরি করে চাকরি নেন তারা। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার চাপে ভুয়া সনদ অনুযায়ী জামুকার সুপারিশের পর গেজেট জারি করত তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ফলে সেই ভুয়া সনদ পরে প্রকৃত সনদ হয়ে যেত।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া ৮৯ হাজার ২৩৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা জমা পড়েছে। এর মধ্যে অনেকের মুক্তিযোদ্ধার সনদ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিশেষত, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও পুলিশ বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়ার সংখ্যা বেশি। নানা জাল-জালিয়াতির অভিযোগও আছে এসব চাকরিজীবীর অনেকের বিরুদ্ধে। গত ১৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ২৯ হাজার ৪৮৫ জন, পুলিশে ২৩ হাজার ৬৩ জন চাকরি পেয়েছেন।

এসব বিষয়ের সত্যতা পাওয়া গেছে জামুকার বিভিন্ন সভার কার্যবিবরণীতেও। কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, দেশের জন্য যুদ্ধ না করেও জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। বীর মুক্তিযোদ্ধার সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাগাতে নিজের বাবা জসমতুল্লাহর নাম বদলে মশমতুল্লাহ করেন। ক্ষমতার দাপটে ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি যাচাই-বাছাইকালে আদমদীঘির প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মজিবরকে বাদ দিয়ে তাঁর লাল মুক্তিবার্তা নম্বর (৩০৬০৯০১২১) ব্যবহার করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু মুক্তিযোদ্ধা বনে যান।

বিষয়টি ধরা পড়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) শুনানিকালে। পরে ২০২২ সালের ১০ মার্চ মজিবর রহমানের (মজনু) ১৮৬৩ নম্বর বেসামরিক গেজেট ও সনদ বাতিল করে মন্ত্রণালয়।

শুধু তাই নয়, সারাদেশে এ ধরনের শতাধিক অমুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করে জামুকা। ভুয়া চিহ্নিত হওয়ার পর গেজেট বাতিলের এ ধরনের আরও নজির রয়েছে। এ বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর-সংস্থা থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্য আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। কারও বিষয়ে অসংগতি পাওয়া গেলেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফৌজদারি মামলা করা হবে। এ পর্যন্ত বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধার সনদ ‘সারেন্ডার’ করে আবেদন করেছেন বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ছিলেন এইচ টি ইমাম। তিনি ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, 'তোমরা অনেকেই বল ছাত্রলীগের চাকরির কথা। দেখ, আমার চেয়ে, নেত্রীর চেয়ে অন্য কার দরদ বেশি আছে? আমরা তো জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি। নেত্রী বলেন, 'যেভাবেই হোক, আমাদের ছেলেদের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তারপর আমরা দেখব।' 

এরপর থেকেই মূলত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরিপ্রাপ্তদের তালিকা দীর্ঘ হতে শুরু করে। রাজধানীর নীলক্ষেত থেকে সনদ বানিয়ে আবেদনের সঙ্গে জমা দিত। সেটা গ্রহণ করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চাপ দেওয়া হতো। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) বলে দেওয়া হতো আবেদন অনুযায়ী গেজেট জারি করতে। সেভাবে কাজ করত করত জামুকা। বিশেষ করে ২৮ থেকে শুরু করে ৩৩তম বিসিএস পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাডারে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যেসব চাকরি হয়েছে তার প্রায় সবই নীলক্ষেতের ভুয়া সনদে নিয়োগ হয়েছে। 

গত ১৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জমা দিতে পারেননি খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী উপখাদ্য পরিদর্শক পদে ২০১০ সালে চাকরিপ্রাপ্ত অনেকে। অনেকের আবার চাকরির আবেদনই পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। একইভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে সরকারি চাকরি করছেন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত মধ্য ভাটেরচরের বাসিন্দা মৃত রজব আলী দেওয়ানের ছেলে মো. আব্দুল হক। তাঁর তিন সন্তানও 'মুক্তিযোদ্ধার সন্তান' কোটায় চাকরি করছেন। 

এক ছেলে পুলিশে, আরেক ছেলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে এবং আরেকজন সুপ্রিম কোর্টে চাকরিরত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইসংক্রান্ত সভায় আব্দুল হক ও তাঁর তিন সন্তানের বিষয়টি ধরা পড়ে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ জন। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। গত ২০ নভেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) পুনর্গঠন করা হয়।

বিকেপি/এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর