মানুষ স্মৃতিকাতর হয়। আবেগে আপ্লুত কিংবা আনন্দে উদ্বেলিত হয়। আর এসব অনুভূতির মধ্য দিয়েই মানুষ এক সময় পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে। পুরোনো দিনের ভুল শুধরে নতুনকে আলিঙ্গন করে নব প্রত্যয়ে, নব আশায়। ঠিক তেমনি মহাকালের আবর্তে বিলীন হয়ে গেল আরেকটি বছর। নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন বছর। স্বাগত ইংরেজি নববর্ষ ২০২৫। স্বাগত নতুন বাংলাদেশ।
অনেক প্রাপ্তি, হতাশা ও নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় শেষ হলো ২০২৪। মঙ্গলবারের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে হতাশা, দুঃখ, স্বজন হারানো এবং অনেক অপ্রাপ্তির বেদনাকে বিসর্জন দিয়ে, আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়ে শুরু হবে নতুন বছর। বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সবাই বরণ করছে নতুন বছরকে। তবে বাংলাদেশের জন্য নতুন বছরটি অনেক সম্ভাবনার। বিগত বছরটি একতরফা নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারের পতন এবং নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
২০২৪ সাল, বাংলাদেশের ইতিহাসের অমর এক স্তম্ভ। দেশ ও মানুষের জন্য নতুন এক অভিযাত্রা। গৌরবোজ্জ্বল এ বছর শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
২০২৪ বাংলাদেশকে বিশ্বের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ লড়াই ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমকালীন বিশ্বের বিরল এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়। জনতার এ অভ্যুত্থান গোটা বিশ্বকে অবাক করেছে।
এ অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম অস্তিত্ব নিয়ে আগামীতে টিকে থাকার প্রেরণা জোগাবে। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট সেই ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ, যা কখনো হারিয়ে যাবে না, শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরবের স্মারক হয়ে থাকবে। এ বছর শেষহীন জুলাইয়ের মতো আমাদের স্মৃতি ও কর্মের মধ্যে উদ্ভাসিত হবে।
এদিকে চব্বিশ সালের প্রথম সাত মাসে, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিল, টানা পনেরো বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার দম্ভে তারা ধরাকে করেছে সরা জ্ঞান। প্রতিপক্ষ তো রাখেইনি, নিজেদের সতীর্থ জাতীয় পার্টি ও চৌদ্দ দলকেও কোণঠাসা করে রেখেছিল। অথচ ৫ আগস্টের পর, দলটির নেতাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অজ্ঞাত স্থানে থাকা, গুটিকয়েক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও, বেশির ভাগই আছেন আত্মগোপনে। আন্ডারগ্রাউন্ড দলের মতোই, ফেসবুক পেজে, কর্মসূচি ঘোষণা করলেও, এটি বাস্তবায়নে হাতেগোনা কয়েকজন কর্মীর বাইরে, কারও দেখা মিলে না।
অন্যদিকে, বিদায়ী বছরটি স্বাভাবিকভাবে আলোচিত বহু ঘটনার কেন্দ্রে ছিল শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগের ছয় মাসেও শিক্ষা খাতে আলোচিত নানা ঘটনা দেখা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলোচিত মন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে সরিয়ে দেওয়া, নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন, পাঠ্যবই বিতরণে দেরি, পাঠ্যবই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, সর্বজনীন পেনশন বাতিলে শিক্ষকদের টানা কর্মবিরতির মতো ধাক্কা শিক্ষা প্রশাসনকে সামাল দিতে হয়েছে। এর মধ্যে বিশে^ বিস্ময় জাগানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বও দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অকাতরে প্রাণ বিলিয়েছেন তরুণরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের মাধ্যমে ইতিহাসে সৃষ্টি হয় ৩৬ জুলাই। ছাত্র-জনতার বহু ত্যাগের বিনিময়ে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
এদিকে আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর, তার দেওয়া সাজানো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্বে পান। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে ৮ আগস্ট রাতে দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন ৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদ, যিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি। বাংলাদেশের জনগণ এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানান ১৯৮ বিশ^নেতা।
অন্যদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরের শুরুতে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। কিন্তু বছরের শেষে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফসল হাতে পেয়েছে দলটি। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, বর্তমানে দেশ গঠনের কাজে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে দলটি।
একই সঙ্গে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। প্রায় সাত বছর পর গত ৭ আগস্ট বিএনপির জনসভায় খালেদা জিয়ার ভিডিও রেকর্ডিং বক্তব্য প্রচার করা হয়। আর এক যুগ পর গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সশস্ত্র বাহিনী দিবসে যোগ দেন তিনি। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আবদুস সাত্তার জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আগামী ৭ জানুয়ারি লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে। তাছাড়া ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের কিছুক্ষণ পর গণমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের বক্তব্য ও ভিডিও প্রচার শুরু করে। ফলে, প্রায় ১০ বছর পর গণমাধ্যমে ফিরে আসেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আর এরই মধ্যে তারেক রহমানের মামলা ও প্রচার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন বেশ কয়েকটি মামলা থেকেও।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিষিদ্ধ থেকে রাজনীতির সম্মুখভাগে এখন জামায়াতে ইসলামী। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধও করে শেখ হাসিনার সরকার। তবে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর সুদিন ফিরে আসে। প্রায় দেড় যুগ পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফেরে দলটি।
বিদায়ী বছরে উচ্চ আদালত ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এ বছর নানা ঘটনা ঘটেছে সুপ্রিম কোর্টে। এর মধ্যে কিছু ঘটনা এমন, যার কোনো নজির অতীতে নেই। উচ্চ আদালতের একটি রায়কে (কোটা পুনর্বহাল) কেন্দ্র করেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। ক্ষমতার পালাবদলে উচ্চ আদালতের সর্বত্র ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। টানা চার মেয়াদ ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা আওয়ামী লীগ উচ্চ আদালতে নিজেদের যে ছক সাজিয়েছিল তা অনেকটা তছনছ হয়ে গেছে।
প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির পদত্যাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতির ছুটি, বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলায় খালাস দেওয়ার ঘটনা ছিল ব্যাপক আলোচিত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা, চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, নাইকো ও গ্যাটকো দুর্নীতি মামলাসহ আলোচিত অনেক মামলার রায় ঘোষণা করা হয় বিদায়ী বছরে। এ সবের মধ্যে আলোচিত ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পুনর্গঠনের কাজ। জুলাই গণহত্যায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ তার অনেক মন্ত্রী-এমপি এবং ব্যবসায়ী ও আমলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে এই ট্রাইব্যুনালে।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আগস্টের শেষ দিকে, দেশের পূর্ব এবং উত্তর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার দুর্যোগ নেমে আসে। ফেনীসহ ১২ জেলা বন্যায় ডুবে যায়। বন্যায় বিপুল সম্পদের ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছে। সরকার বন্যা মোকাবিলায় সম্মিলিত পদক্ষেপ নিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনসহ সারা দেশের মানুষ বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান।
বিদায়ী বছরে স্বাস্থ্য খাতের প্রধান শত্রু ছিল মশা, যাতে নীরবে ঝরেছে কয়েকশ প্রাণ। বিগত ২৫ বছরে ডেঙ্গুকে জয় করার পরিবর্তে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করেছে সংশ্লিষ্ট খাতগুলো। ২০১৯ ও ২০২৩ সাল ছিল ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের টার্নিং পয়েন্ট। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ডের বছর ২০২৩ ছিল মশার বিরুদ্ধ পরাজয়ের এক মাইলফলক। ২০২৪ সালে সংক্রমণ ও মৃত্যু তুলনামূলক কমলেও তা এযাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরেও ডেঙ্গু সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে হাসপাতালগুলো।
২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঘটনাবহুল এক বছর। রাজনৈতিক পালাবদলের প্রভাব যেমন পড়েছে ক্রিকেট অঙ্গনে, তেমনি মাঠের সাফল্য-ব্যর্থতার সঙ্গে জড়িয়েছে ক্ষমতার পরিবর্তনের গল্প। নাজমুল হাসান পাপনের যুগের সমাপ্তি, পাকিস্তানের মাটিতে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়, হাথুরুসিংহের বিতর্কিত বিদায়, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের টানা দ্বিতীয় এশিয়া কাপ জয় এবং সাকিব আল হাসানের বিতর্ক এবং বিদায়ী টেস্ট। সব মিলিয়ে বছরের প্রতিটি অধ্যায় ছিল আলোচনায়।
বিদায়ী বছর সোনার দাম ছিল আকাশছোঁয়া। এ বছর ৫৬ বার সমন্বয় করেও বাজারে অস্থিরতা কাটেনি। দেশের বাজারে বছরের পুরো সময়টাই সোনার দাম ছিল লাখ টাকার ওপরে। যদিও দামি এই ধাতু সোয়া লাখের ঘর পাড়ি দিয়েছে দুই মাস আগেই।
অন্যদিকে, বছরে শেষ দিকে ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে আগুনে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ৬ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোর পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ভবনটির চারটি তলায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছাই হয়ে যাওয়া চারটি ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ছিল।
ওএফ