গত ২৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যা দ্রুত গোটা ভবনে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ঘটনায় গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ ছিল দুর্বল বিদ্যুৎ সংযোগ এবং বৈদ্যুতিক স্পার্ক, যা ধীরে ধীরে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
তদন্ত কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি জানান, ‘‘কমিটি একমত হয়েছে যে, লুজ কানেকশনের কারণে বৈদ্যুতিক লাইনে আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল।’’ তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিকভাবে আগুন ছোট ছিল, কিন্তু বিদ্যুতের সংযোগের কারণে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’’
কমিটির সদস্য বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালী বলেন, আগুনের সূত্রপাত রাত ১টা ৩২ থেকে ১টা ৩৯ মিনিটে। অর্থাৎ এই আগুনের উৎপত্তি একটি নির্দিষ্ট সময়ে নয়। যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানে ৭ মিনিট ধরে আস্তে আস্তে গরম হয়েছে। প্রথম দিকে থেকে সেখান স্ফুলিঙ্গ (ফুলকি) পড়েছে। এক সময় ভীষণ তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়েছে। এরপর আগুন ধরেছে। আগুনের চেইন তৈরি করেছে। সচিবালয়ের বিল্ডিংয়ের একটি টানেলের অ্যাফেক্টের কারণে আগুন পশ্চিম দিক থেকে গিয়ে পূর্ব দিকে বেড়িয়ে গিয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে এই কারণেই আগুন দুইদিকে দেখা গেছে।
তিনি বলেন, আগুনের উৎস এই একটাই। এর বাইরে আপাতত কোনো কারণ নেই। তার মতে, বাতাসের গতি ও বিল্ডিংয়ের ভিন্নতার কারণে আগুন দুইদিকে প্রভাবিত হয়েছে।
তিনি আরও জানান, পুলিশের সিআইডি রিপোর্ট ও অন্যান্য ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে আমাদের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ৯৯ শতাংশ মিলে গেছে। মাকসুদ হেলালী বলেন, আমরা নিশ্চিত হয়েছি, আগুন এভাবে সৃষ্টি ও ছড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে আগুন সচিবালয়ের উত্তর দিকে দেখা গেছে। দক্ষিণ দিকে দেখা যায়নি। যেখানে বাইরে থেকে আমরা সচিবালয় দেখি।
কমিটির আর এক সদস্য সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রাসেল বলেন, আমরা তিনটা জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করি। ফায়ার সার্ভিস একটা নমুনা দিয়েছে- যে কোনো ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে এখানে আগুন লাগানো হয়েছে কি-না এটা যাচাই করেছি। এই নমুনাগুলো সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীর একটি উচ্চমানের বিস্ফোরক ল্যাব রয়েছে। সেখানে উচ্চমানের বিস্ফোরক ডিটেক্টর রয়েছে। আমরা নমুনা পরীক্ষা করে বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রমাণ পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের যে নমুনা তাতেও কোনো বিস্ফোরকের ব্যবহার মেলেনি। এরপর আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট ডগ স্কোয়াড ব্যবহার করেছি। এই স্কোয়াড গন্ধ শুঁকে বিস্ফোরক চিহ্নিত করতে পারে। তাতেও কোনো ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহারের আলামত মেলেনি।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, আমাদের প্রথম যে তিনটা দল অগ্নিকাণ্ড নির্বাপনে যুক্ত হয়, তখন আগুন পুরো বিকশিত অবস্থায় ছিল। আমাদের টিম যখন সিঁড়িতে পৌঁছায় তখন আগুন ছড়িয়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের ইউনিটগুলো এসেছে। দক্ষিণ দিক থেকে দুটি গাড়ি সচিবালয়ের সামনে স্থাপন করতে সমর্থ হই। এর মধ্যে আমাদের অগ্নিনির্বাপক দল গতানুগতিক পদ্ধতিতে আগুন নেভানোর কাজে সক্রিয় ছিল। প্রতিটি ফ্লোরে চারটি করে কলাপসিবল গেইট ছিল। এ ছাড়া করিডরের মধ্যে ছিল টানেল গেইট। বের হওয়ার জায়গা না থাকায় তাপমাত্রা এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখানে যেহেতু ইন্টেরিয়র ডিজাইন ছিল। ফলে প্রচুর পরিমাণ বৈদ্যুতিক তারের সমাবেশসহ অনেক দাহ্যবস্তু মিলেছে। এগুলো আগুন ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করেছে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের সঙ্গে রুমের পার্টিশন পাশাপাশি কাগজপত্রের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। আগুনের ডিটেক্টর সিস্টেম এবং কন্ট্রোল প্যানেলে ঘাটতি ছিল। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে।
এছাড়া, তদন্তে জানা গেছে, আগুনের বিস্তার হওয়ার সময় সচিবালয়ের আগুনের ডিটেক্টর সিস্টেম এবং কন্ট্রোল প্যানেলে কিছু ঘাটতি ছিল। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে বিলম্ব হয়।
তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, কোনো বিস্ফোরক ব্যবহার করে আগুন লাগানো হয়নি এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণে এখনও কাজ চলছে।
ডিআর/এমএইচএস