পিলখানা হত্যাকাণ্ড
শহীদ মিনারে বসে পড়লেন চাকরিচ্যুত বিডিআর জোয়ান-স্বজনরা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, ঢাবি
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩:৩২
২০০৯ সালে ঘটে যাওয়া পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জেলবন্দীদের মুক্তিসহ তিন দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন চাকরিচ্যুত বিডিয়ারের সদস্য ও তাদের স্বজনরা৷
বুধবার (৮ জানুযারী) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। একই দাবিতে রাতেও এখানেই অবস্থান পালন করবেন তারা।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার সকাল ১০টার দিকে তারা প্রথমে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার জড়ো হোন। পরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন। পদযাত্রাটি শাহবাগ থানার সামনে এলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যস্থতায় একটি প্রতিনিধি দল তাদের দাবি-দাওয়া সম্বলিত একটি স্মারকলিপি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে যান। অন্যরা শাহবাগেই অবস্থান করেন।
দাবি মেনে নেওয়া না হলে বৃহস্পতিবার থেকে শাহবাগ ব্লকেড করা হবে এমন ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মাহিন সরকার। এর আগে ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মাহিন সরকারের নেতৃত্বে বুধবার দুপুরের দিকে পুলিশের গাড়িতে তারা যমুনায় যান।
সন্ধ্যায় শাহবাগে মহিন সরকার বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে শুনতে চেয়েছিলাম আর যেন শুনানি পেছানো না হয়। কারণ ৫ আগস্ট পর অনেকবার শুনানি পেঁছানো হয়েছে। যদি ন্যায়বিচারের কোনো ইঙ্গিত না দেখি তাহলে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) শাহবাগ ব্লকেড করা হবে। একই সঙ্গে আমাদের কর্মসূচি চলমান থাকবে।
মাহিন বলেন, আজ সারারাত শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। যদি আমরা ন্যায়-বিচারের ইঙ্গিত না পাই, কোর্ট ও সরকারের কাছ থেকে অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট না পাই তাহলে পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করব।
তিন দাবি
যে তিন দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন তারা সেগুলো হলো- ১. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সকল বিডিআর জেলবন্দীদের মুক্তি; ২. পিলখানা হত্যাকাণ্ডে মিথ্যা মামলা বাতিল, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল ও পুনর্বাসন ; ৩. প্রজ্ঞাপনে ‘ঙ’ ধারা বাতিলসহ পিলখানা হত্যা মামলায় পুনঃতদন্ত ও ন্যায়বিচার । বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই দাবিগুলো যেন মেনে নেওয়া হয় এর পক্ষে বক্তব্য দেন বিডিআর সদস্যরা।
জেলে যেসব বিডিআর সদস্য রয়েছেন তাদের অবিলম্বে মুক্তি চাই উল্লেখ করে অবস্থান কর্মসূচিতে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য শেখ আব্দুর রহমান বলেন, যাদের চাকরি অবৈধভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যাদের জেল খাটানো হয়েছে, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়াসহ ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ রাজপথ ছাড়ব না।
চাকরিচ্যুত বিডিআরের ৭৬তম ব্যাচের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি ৭৬তম ব্যাচের রিক্রুট ছিলাম। ওই সময় আমি প্রশিক্ষণে ছিলাম। একজন নবীন সৈনিক কোনোভাবেই সিনিয়রের কথা ছাড়া কোনো কিছুই করতে পারেনি। আমাদের দ্বারা বিদ্রোহ সম্ভব ছিল না।
তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার পিলখানায় কেবল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ২৬ ফেব্রুয়ারি ট্রেনিং গ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায় খবর আসে, আমাদের ওপর আক্রমণ করতে সেনাবাহিনী আসছে। আমরা যে যার মতো রুমে চলে যাই। বাইরে কী হচ্ছিল আমরা কিছুই জানতে পারিনি। ২৬ জুন আমাদের শপথ নেওয়ার কথা থাকলেও ২৪ জুন আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। আমরা চাকরি ফেরত পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন করলে বিগত সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী আমাদের মারধর করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। চাকরি চলে যাওয়ায় অনেক বিডিআর সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।
তিনি বলেন, আমাদেরকে জেল-জুলুমসহ নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। সেই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। আমরা এখন আমাদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিচার চাই। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ রাজপথ ছাড়ব না। আগামীকালের মধ্যে নিঃশর্তভাবে বিডিআর সদস্যদের মুক্তি দিতে হবে।
চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যের সন্তান মো. একরামুল হক বলেন, আমার বয়স যখন ৫ বছর তখন পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটে। যখন এই হত্যাকাণ্ড হয়, তখন আমার পরিবার পিলখানায় ছিল। হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর আমাদের বাসায় কেউ একজন এসে জানায় যে, ঝামেলা হচ্ছে। সবাই বের হয়ে যেতে বলা হয়।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে আমার বাবাকে এক বছরের জেল দেওয়া হয়। জেল থেকে বের হওয়ার এক বছর পর বুকে কষ্ট নিয়ে তিনি পরলোক গমন করেন। যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন ততদিন অনেক কষ্টে কাটিয়েছেন। বাবার আর্তনাদ এখনো ভুলতে পারি না। তার ডায়রি পড়লে এখনো চোখের পানি আটকে রাখতে পারি না।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ভারত থেকে প্রশিক্ষিত ‘র’ এর এজেন্টদের পিলখানায় জমায়েত করে পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। ভারতের বিএসএফ বিডিআরকে ভয় পেত। তাই তারা চায়নি বিডিআরের নাম থাকুক। ভারতীয় যোগসাজশে পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।
স্মারকলিপি প্রদান
বুধবার দুপুরে ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। তবে এর প্রেক্ষিতে তাদেরকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।
স্মারকলিপিতে তারা লিখেন, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি, পিলখানায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা ১০ জন, বিডিআর সদস্য ও ৭ জন বেসামরিক সহ মোট ৭৪ জন নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। এটি ছিল দেশের ইতিহাসের একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তৎকালীন সরকার এই হত্যাকাণ্ডকে বিডিআর বিদ্রোহ হিসেবে চালিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে হাজার হাজার নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদেরকে যড়যন্ত্রমূলকভাবে অভিযুক্ত করা হয় এবং গণহারে চাকরিচুত্যিসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ঘটনা ও বাইরের ব্যাটালিয়ন ও স্থাপনার ঘটনা এক নয়। পিলখানায় হয়েছে হত্যাকাণ্ড আর পিলখানার বাইরের স্থাপনায় হয়েছে ষড়যন্ত্র। ২০০৯ সালের খানার চেইন অব কমান্ড ভেঙে দেওয়ার পর বাহিরের ব্যাটালিয়নগুলোকে তাৎক্ষণিক জরুরি কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় না এনে তাদেরকে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়া হয়।
স্মারকলিপিতে জানানো হয়, ষড়যন্ত্রমূলক গুজব ছড়িয়ে এবং পরিকল্পিতভাবে সারাদেশের ব্যাটালিয়ন, সেক্টর ও অন্যান্য স্থাপনার কমান্ডারদের সরিয়ে নিয়ে জোয়ানদের মনোবল ভেঙে বিভিন্ন কৌশলে সেনাবাহিনী আক্রমণের গুজব প্রতিষ্ঠিত করে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত সারাদেশে বাইরের স্থাপনাগুলো শান্ত ছিল। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে বিডিআরের কয়েকটি স্থাপনার নিকটবর্তী স্থানে ভারি অস্ত্রসহ সেনাসদস্যরা অবস্থান নেয়। যে কারণে শান্ত বিডিআর সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। যা ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখ বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রচারিত হয়। এর প্রেক্ষিতে বাহিরের ইউনিটে বসবাসরত পরিবার, সম্পদ ও নিজেদের জানমাল রক্ষার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নিরপরাধ জোয়ানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ এনে ঢালাওভাবে চাকরিচুত্য করা হয় ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়।
স্মারকলিপিতে জানান, পিলখানার বাইরের ব্যাটালিয়ন ও অন্যান্য সকল স্থাপনায় গণহারে চাকরিচুত্য বিডিআর সদস্যদের নির্বাহী আদেশে ভূতাপেক্ষনীতিতে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। প্রজ্ঞাপনের ২(ঙ) ধারা বাতিল করে কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। পিলখানার হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে।
ওএফ