Logo

জাতীয়

ধানমন্ডি-৩২ ভাঙচুর : রাজনীতিবিদদের কে কোন পক্ষে

Icon

ডিজিটাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:২০

ধানমন্ডি-৩২ ভাঙচুর : রাজনীতিবিদদের কে কোন পক্ষে

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়ি, শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং মুজিব পরিবারের সদস্যদের নামসম্বলিত ফলক ভাঙচুরের ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

এ ধরনের ঘটনা উসকে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছে প্রায় সব দলই। আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাকেও দায়ী করেছেন কেউ কেউ।

দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে, এত মানুষের মৃত্যু ও ১৫ বছরের নির্যাতনের ক্ষোভ মানুষের মধ্যে জমে ছিল। এ ঘটনায় আরও একবার মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে।

অন্যদিকে রাজনৈতিক উত্তেজনাকে রাজনীতির মাধ্যমেই সমাধান করা উচিত বলে মনে করছে জামায়াতে ইসলামী। কোনো অবস্থাতেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়া কাম্য নয় বলেই মত দলটির।

এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা বলছে, গণহত্যার দায় স্বীকার না করলে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সামনেই নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার কথা রয়েছে প্ল্যাটফর্মটির।

তবে বিশৃঙ্খলার জন্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নাগরিক ঐক্য ও ছাত্র অধিকার পরিষদ। এই ঘটনায় সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলেই মত দল দুইটির।

যেভাবে ঘটনার শুরু
অভ্যুত্থানের ছয় মাস উপলক্ষে ছাত্র সমাজের উদ্দেশে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ দেয়ার কথা জানায় নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এর পরপরই এ নিয়ে দেখা যায় তীব্র প্রতিক্রিয়া।

শেখ হাসিনা ভাষণ দিলে ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের নানা পেজ থেকে। তবে ভাষণের আগেই সেখানে ভাঙচুর শুরু হয় এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

পরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার বাড়ি সুধাসদনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

এ সময় বিভিন্ন স্থানে থাকা শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং মুজিব পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ফলক ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।

দেশব্যাপী এমন অস্থিরতা দেখা গেলেও এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অফিসিয়ালি কোনো বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।

বিবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘এত লোকের মৃত্যু হয়েছে, শহীদ হয়েছে, মানুষ তো বিক্ষুব্ধ ছিল গত ১৫ বছরের নির্যাতনে।’

ভাষণের খবর আসায় সেই ক্ষোভ দূর হওয়ার আগেই নতুন করে ক্ষোভকে উসকে দেওয়া হয়েছে বলেই মত তার। ‘তারা (আওয়ামী লীগ) তো চুপচাপ থাকতে পারতো।’

এ ঘটনায় জামায়াতে ইসলামী বলছে, রাজনৈতিক বিষয়গুলোর জন্য যে উত্তেজনা তা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করা উচিত।

দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করি রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা দরকার। কারণ একটা শক্তি বা একটা মবকে আরেকটা শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে গেলে সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হয়। অতীতে তা-ই দেখা গেছে।

রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এই উত্তেজনা প্রশমিত হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

‘শেখ হাসিনাই এসব ঘটনা উসকে দিয়েছেন’
এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী বলে মনে করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ‘ফ্যাসিস্টের প্রতীক’ হিসেবে উল্লেখ করে বুধবারের ঘটনাকে ‘যথাযথ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ’ বলে মন্তব্য করছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন।

আর ‘আওয়ামী লীগের কারণেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে’ বলেও মনে করছেন তিনি।

‘আমরা আওয়ামী লীগের রিকনসিলিয়েশনের ব্যাপারে বলেছিলাম, কিন্তু তারা জুলাই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অনুতপ্ত নয়, বরং দিল্লিতে বসে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে,’ বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘৭২ থেকে ৭৫-এ এই বাড়িকে কেন্দ্র করে যে কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, সেই কাঠামোর মধ্য দিয়েই জনগণকে শোষণ করা এবং বিপুল মানুষকে হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে। আমাদের সেই ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।’

‘যে কোনো ধরনের ফ্যাসিস্ট কাঠামো, যেকোনো রকমের ফ্যাসিস্ট উপাদান বাংলাদেশের মানুষ ভেঙে ফেলবে এবং সেটা রাখতে দেবে না- এটা তাদের নাগরিক কর্তব্য। ক্ষোভের জায়গা থেকে তারা এটা করবে,’ বলেন তিনি।

৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা ‘পরিকল্পিত’ উল্লেখ করে সামান্তা শারমিন বলেন, ‘এটা প্ল্যানড এবং দেখেছি ঘোষণা করেই এসেছে। প্ল্যানিংয়ের যেহেতু অংশ আছে, এখানে বিশৃঙ্খলা ঘটার কোনো সুযোগ নেই।’

আর গণহত্যার দায় স্বীকার না করলে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে ‘শেখ হাসিনা নিজেই পুরো ঘটনা উসকে দিয়েছেন’ বলে মনে করছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।

জুলাই হত্যা এবং ১৫ বছরের ‘দুঃশাসন’ নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কোনো অনুতাপ না থাকায় মানুষের ‘সেন্টিমেন্ট খুব হাই’ আর তাদের ‘বাড়াবড়ির’ কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মত মান্নার।

তবে তা সত্ত্বেও এই ধরনের ঘটনাকে ‘অনুমোদন করেন না’ বলে জানান তিনি।

‘আমরা রাজনৈতিকভাবে, শারীরিকভাব ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছি। এই ফ্যাসিবাদ যেন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে, তারজন্য লড়াইটা রাজনৈতিকভাবেই হতে হবে,’ বলেন মান্না।

এক্ষেত্রে পতিত আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি আরও কিছু ফ্যাক্টরকে দায়ী বলে মনে করছেন ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হক নূর।

‘পতনের মুখেও পতিত স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উসকানিমূলক ও জনগণের সেন্টিমেটের বিপরিতে কথা বলে যাচ্ছেন- এটা যেমন ঠিক, আবার দেশের ভেতরেও নানা ধরনের গ্রুপ তৈরি হয়েছে যারা দেশে অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে চায়। তাদেরও নানা ধরনের ইন্ধন আছে,’ বলেন তিনি।

দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ এগুলোকে উৎসাহিত করছে বলেও মন্তব্য করেন নূর।

ভেকু-বুলডোজার এলো কোথা থেকে?
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দিলে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ভবনটি ভাঙা হবে, সেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল আগেই। বুধবার রাতে এবং বৃহস্পতিবার সকালে ভেকু দিয়ে ভাঙাও হয়েছে ভবনটি।

একই ঘটনা ঘটেছে খুলনায় শেখ হাসিনার চাচার ও কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়িতেও।

আগে থেকে ঘোষণা দেওয়ার পরও সরকার কেন কেন ব্যবস্থা নিলো না কিংবা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে কিনা, উঠছে এমন প্রশ্নও।

এ নিয়ে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর বলেন, এখানে মনে হয় সরকারের ভেতর থেকে সমর্থন রয়েছে। না হলে তো এভাবে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে এই পদক্ষেপ নেওয়া কিংবা এই কর্মযজ্ঞে পাবলিককে উত্তেজিত করে অস্থিরতা তৈরি করা– এটা তো সরকারের ভেতরের সমর্থন ছাড়া হওয়ার কথা না।

একই সঙ্গে উপদেষ্টাদের দিকেও আঙুল তোলেন তিনি। বলেন, ‘আমরা তো দেখি নাই, সরকারের ভেতর থেকে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বরং সরকারের উপদেষ্টাদের কারও কারো ফেসবুক লেখাতেও আমরা দেখেছি যে এটাতে সমর্থন রয়েছে। সরকার যদি এই ধরনের কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেয় তাহলে তো নৈরাজ্য তৈরি হবেই।’

অন্যদিকে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলছেন, এই ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুবই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।

বিশেষ করে এই বুলডোজার কোথা থেকে এলো- এমন প্রশ্নও তুলে তিনি বলেন, সরকার যদি এভাবে এটাতে ইনভলভ হয়ে যায় সেটা খুবই দুঃখজনক এবং খুবই উদ্বগের কারণ। এরকম পথ থেকে সরকারকে অবিলম্বে সরে আসা উচিত।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বুধবার রাত নয়টায় শেখ হাসিনা ভাষণ দেওয়া শুরু করলেও তার আগেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভাঙচুরের ঘটনা শুরু হয়, যা পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু এ নিয়ে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো ওইভাবে কাজ করছে না। প্রশাসন আর সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা চেষ্টা করছে।

আস্তে আস্তে সরকারকে কঠোর হতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, গতকাল যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি এখনো চলমান। এটি কারা করেছে, সেই তথ্য আমাদের কাছে নাই। এতে সরকারের কী ভূমিকা ছিল সেই তথ্য আমাদের কাছে নাই।

পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেলে পরে এবিষয়ে মন্তব্য করবে বলেও জানান তিনি।

প্রশাসনের ভূমিকা স্পষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র আকন্দও।

তিনি বলেন, গতকাল রাতে ঘটনায় প্রশাসন কী ভূমিকা পালন করেছে, আমরা তা অবজার্ভ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু জিনিসটা এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

স্পষ্টভাবে অবহিত না হওয়ায় এবিষয়ে মন্তব্য করবেন না বলে জানান তিনি।

অবশ্য কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটেছে বলেই মনে করছে না জাতীয় নাগরিক কমিটি। কেবল আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভের জায়গা থেকে এটা ঘটেছে বলেই মনে করছে তারা।

বরং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সরকার নিজেদের কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেন সামান্তা শারমিন।

তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপস্থিত ছিল এবং সেখানে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

‘তারা দেখেছে ওখানে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এবং আমরা দেখেছি যে এখানে তাদের ইন্টারাপশনের কোনো প্রয়োজন পড়েনি,’ বলেন তিনি। সূত্র : বিবিসি

ডিআর/বিএইচ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর