Logo

মতামত

অর্থনীতির মধ্যম আয়ের ফাঁদের ভয়, বাস্তবতা

Icon

সাইদ আরমান

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১১:৩২

অর্থনীতির মধ্যম আয়ের ফাঁদের ভয়, বাস্তবতা

অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে অন্তর্বর্তী সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি করে ছিল। কমিটি তার প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। যদিও, কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এ মর্মে কমিটির সদস্যরা মুখ খুলতেও শুরু করেছেন। 

তবে, সুপারিশ সরকার বাস্তবায়ন করুণ কিংবা না করুক, সেখানে কিছু বাস্তব চিত্র জানা গেছে। কমিটির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও, এটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা চলছে অনেক দিন থেকে।

আমি নিজেও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানের সঙ্গে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে যাওয়া-বাস্তবতা কি নিয়ে অনেকবার কথা বলেছি। তিনি অবশ্য বারবার বলেছেন, ন্যূনতম তিন বছর সময় নেয়া দরকার। অর্থাৎ, ২০২৯ সালের আগে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে যোগ না দেয়ার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। একই বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা বার বার কথা বলেন। তারাও অর্থনীতির কথা চিন্তা করে, বিরোধিতা করছেন।

মোটা দাগে, মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে কি তাহলে বাংলাদেশ? শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অর্থনীতিতে ছয়টি লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যেগুলো বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। লক্ষণগুলো হচ্ছে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের বিপরীতমুখী সম্পর্ক; শিল্প খাতে উৎপাদন স্থবিরতা; মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রপ্তানি খাতের অপর্যাপ্ত অবদান; বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগের অপ্রতুলতা এবং সুশাসনের অভাব। গত দশকের মাঝামাঝি পর্যায় থেকেই বাংলাদেশ এই ফাঁদে পড়তে শুরু করে।

সরকারের এ নথি বলছে, গত ৫০ বছরে ১০০ দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, মাথাপিছু আয় ৮ হাজার ডলার স্পর্শ করেই তারা মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছে; যদিও বাংলাদেশ এখনো সেই পর্যায়ের মাথাপিছু আয়ের কাছাকাছি নেই।

একটি বিশেষ, আমাদের অনেকের কাছে স্পষ্ট। এক-দেড় দশকে জাতীয় অগ্রযাত্রাকে এক জায়গায় থামিয়ে দেয়া হয়েছে। দৌড়ানোর পরিবর্তে আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছি। যদিও সেটিও সম্ভব হয়েছে বেসরকারি খাতের কারণে। সরকারি ব্যয়ে আমরা দেখেছি লুটপাট। বলা যায়, সর্বাঙ্গে ব্যথা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাটাকে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে যাওয়া বলা হচ্ছে। 

আমরা দেখেছি, নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন খাতে যেসব সংস্কার হয়েছে, তার অনেক সুফল পেয়েছে অর্থনীতি ও সামাজিক খাত। কিন্তু পরে সেই সংস্কারের ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে পারিনি; বরং উল্টো কাজ করেছি। নতুন সংস্কারও তেমন একটা হয়নি। ব্যাংক খাতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে আইন কানুনের বাইরে সুযোগ দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অকার্যকর করা হয়েছে। দুদক যেন কাজ করেছে সরকারের ইচ্ছায়, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। কেবল তাই নয়, ধ্বংস করা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। এসব কারণেই আমরা খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে চলছি।’

অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে নিম্ন আয়, মধ্যম আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ, এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক। আবার মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে নিম্ন মধ্যম আয় ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে ভাগ করা হয়।

সংস্থাটির হিসাব অনুসারে, বর্তমানে কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৫ মার্কিন ডলারের কম হলে সেটি নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ছাড়া মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৬ থেকে ৪ হাজার ৫১৫ ডলার হলে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ৪ হাজার ৫১৬ থেকে ১৪ হাজার ৫ ডলার হলে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গণ্য হয়। আর ১৫ হাজার ৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় হলে উচ্চ আয়ের দেশ চিহ্নিত হয়। 

বহু দেশ বহু বছর ধরে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পড়ে আছে। এ জন্য সেগুলো মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন তিন হাজার ডলারের নিচে, আড়াই হাজার ডলারের ওপরে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সময় ঠিক করা হয়েছে। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।

বাংলাদেশের সামনে ধাপ দুটো ধাপ। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, যার জন্য দরকার প্রায় ৪ হাজার ৩০০ ডলার মাথাপিছু আয় করা। তারপর উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, যার জন্য দরকার হবে প্রায় ১৫ হাজার ডলার মাথাপিছু আয়।

কিন্তু উন্নত দেশ বা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে কমপক্ষে ২৭ বছর সময় লাগবে, যদি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৬ ভাগ। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ ভাগ ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৭ দশমিক ৩ ভাগ। এ থেকে এক ভাগ কমিয়ে ধরলে উচ্চ আয়ের দেশ হতে ৩২ বছরের মতো সময় লাগবে। কে যে ২০৪১ কে উন্নত দেশ হওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন তা এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিবেচনায়, উত্তরণের তিন সূচকের দুটিই বাংলাদেশ অর্জন করেছে। তাই, এটি আর পিছিয়ে নেয়ার সুযোগ আছে কিনা, সেটিও বড় বিষয়। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট সব মহল চায়, এটি আপাতত কয়েক বছর পিছিয়ে নেয়া। মনে রাখতে হবে, ফাঁদে পড়লে পুরো অর্থনীতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ব্যবসা, বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক সুযোগ কমে যাবে কিংবা বাতিল হতে থাকবে। তাতে বৈশ্বিক বাণিজ্যেও নতুন চাপ মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। 

আরও একটি বিষয়, আলোচনায় আনা দরকার। যেসব সূচক ধরে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের পথে। বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশের এসব পরিসংখ্যান নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। কাজেই ওই সব পরিসংখ্যানে ভড় করে, উত্তরণটাও কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে। এটি এখন অনেকেই বলে, বিগত এক দেড় দশক, দেশের উন্নতি দেখাতে ক্ষমতাসীনরা অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান সাজিয়ে ছিলেন। 

  • লেখক : বিশেষ প্রতিবেদক, নাগরিক টেলিভিশন
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর