কাল্পনিক গল্প দিয়ে শুরু করি। ধরা যাক বাংলাদেশের কোনো এক ছায়া-ঢাকা মায়া-মাখা গ্রামের একটি টিনশেড স্কুল। কল্পনার চোখ খুলে সেদিকে তাকাতেই দেখা গেল, কোনো এক শিক্ষার্থীর বাবা-মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে প্রধান শিক্ষকের রুমের দিকে যাচ্ছেন। বাবার কপাল ঘামে চপচপে, মায়ের চোখ জলে ছলছল করছে।
‘স্যার, ছেলেটা পরীক্ষা দিতে চায়, পড়াশোনা করতে চায়’— বাবার গলা কম্পমান। ‘কিন্তু, আমি এখনও পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে পারিনি।’
প্রধান শিক্ষক তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শেলফে কোনো ফাইল খুঁজতে খুঁজতে ডানে-বামে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘আমার আর কী করার আছে বলুন? ফি ছাড়া তো আমি পরীক্ষায় বসতে দিতে পারি না।’ কথাটা বলে শেলফ থেকে একটা ফাইল হাতে নিয়ে এমনভাবে চেয়ারে বসলেন যেন রাজ্যের ভার তার একার কাঁধে। অসহায় বাবা-মায়ের মুখ শুকিয়ে গেল, যেন হঠাৎ বাতাসে নিভে গেল মোমবাতি।
গল্প এখানেই থামিয়ে একটা জরুরি প্রশ্ন তোলা যাক বরং। এই যে শিশুটির স্কুলের পরীক্ষার ফি বা পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য তার বাবা-মায়ের নেই, কেনো নেই? এ কি শিশুর বাবা-মায়েরই অক্ষমতা? নাকি এই দায় আরও কারও আছে?
টাকা নেই বনাম ক্ষমতা নেই
শিশুটির বাবা-মায়ের কাছে তার পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার মতো ‘টাকা নেই’ নাকি তাদের ‘ক্ষমতা নেই’— শব্দ বা বলার ধরনে দায়দায়িত্বের অবস্থান বদলে যায় অনেকখানি। প্রথমটা সমস্যার গভীরে পৌঁছে নাগরিক হিসেবে এই পরিবারটির যা কিছু পাওয়ার কথা ছিল, অথচ পায়নি, সেদিকে ইঙ্গিত করে। আর ক্ষমতা নেই বললে সবকিছুকে উপেক্ষা করে বা এড়িয়ে গিয়ে সরাসরি ব্যক্তির অক্ষমতাকে দায়ী করে রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।
আমরা যদি বলি, এই পরিবারের কাছে তাদের সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার মতো ‘টাকা নেই’, তাহলে ভাবার সুযোগ থাকে, রাষ্ট্র শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট রাখতে পারছে কি? যে বাজেট রাখছে তার সুষম বণ্টন হচ্ছে তো? এই শিশুটির শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের কী দায়িত্ব আছে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কতটুকু সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে? সেটা কি তারা পালন করছে? যদি করে তাহলে এই পরিবার কেন বঞ্চিত হলো? তাদের কাছে কেন পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট টাকা নেই?
কিন্তু যখন বলে দেওয়া হয়, তাদের ‘ক্ষমতা নেই’, তখন এই ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয় যে, রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান সকলেই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। তবুও এরা তাদের সন্তানের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই এরা ব্যর্থ।
কিন্তু সত্যি সত্যি কি আমাদের রাষ্ট্র-সমাজের সবগুলো ক্ষেত্র যথাযথভাবে সবটুকু করতে পারছে বা করে?
রাষ্ট্র ও সমাজের দায়
কেবল বলার ধরনের পার্থক্যে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সমস্যা ব্যক্তিগত না রাষ্ট্রীয়। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রভাব ব্যক্তির মনেও পড়ে।
যখন কোনো কৃষকের ছেলে বলে, ‘আমার স্কুলের বেতন দেওয়ার মতো টাকা নেই’, তখন প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে যে, আমাদের অন্ন জোগাচ্ছেন যে কৃষকেরা, তাদের কাজের বিনিময়ে কতটুকু আয় করতে পারছেন? তা কি তাদের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট? যদি না হয়, তাহলে কেনো না? এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী?
আর যদি বলি ওই কৃষকের ‘ক্ষমতা নেই’ ছেলেকে পড়ানোর, তাহলে সমস্যা কেবল সেই পরিবারের মধ্যে আটকে যায়। আর রাষ্ট্র দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
অথচ এমন বাস্তবতাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকারি স্কুলে আসন থাকে তো শিক্ষক থাকে না। আবার বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার মান তুলনামূলক ভালো হলেও টিউশন ফি শুনলে অনেক বাবা-মায়ের মাথা ঘুরে যায়। তখন স্বাভাবিকভাবে আমার বলি যে, সেই বাবা-মায়ের ‘ক্ষমতা নেই’, যেন সন্তানকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে না পারার ব্যর্থতার দায় তার নিজের দোষ। রাষ্ট্র আর সমাজ তখন নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে না পারার ব্যর্থতার দায় ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ডুগডুগি বাজায়।
অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো তার নাগরিকদের জন্য মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা। প্রয়োজনীয় আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে কাউকে অন্তত মৌলিক চাহিদা পূরণের বেলায় টাকার অভাবের কথা বলতে হবে না।
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
এইচকে/এমএইচএস