ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই একবার ইসলামাবাদ সফরে গিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে ‘যুক্ত জমজ’ (জোড়া লাগানো শরীর) বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু কয়েক দশকের অবিশ্বাস, গভীর সন্দেহ ও বৈরিতার কারণে দুদেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এখন দুই দেশের সম্পর্ককে প্রেম-ঘৃণার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এর পেছনেও রয়েছে বিরাট ইতিহাস।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে এই সম্পর্ক একেবারে ভুল পথে শুরু হয়েছিল। ওই সময় পাকিস্তান জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। আর আফগানিস্তান একমাত্র দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সদস্যপদ লাভের বিরোধিতা করেছিল। দুই দেশের সীমানা বিভক্তকারী ডুরান্ড লাইনকে স্থায়ী সীমান্ত হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি জানিয়েছিল আফগানিস্তান।
এরপর আফগানিস্তানের এই মতপার্থক্য নিয়ে পাকিস্তান আলোচনায় রাজি হলে একই বছরের অক্টোবরে কাবুল তার বিরোধিতা প্রত্যাহার করে নেয়। তবে ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
পাকিস্তানে বসবাসরত পাখতুন ও বেলুচদের প্রতি আফগানদের সমর্থনকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। রাজা জহির শাহের চাচাতো ভাই দাউদ খান রাষ্ট্রদূত হিসেবে ‘পশতুনিস্তান’ অভিযানের নেতৃত্ব দেন। পরে যখন তিনি আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হন, তখন উপজাতীয় রিয়াসাত (অধিদপ্তর) প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর ১৯৭৩ সালে উপজাতীয় অঞ্চল এবং পাকিস্তানের পাখতুন ও বেলুচ অঞ্চল তদারকির জন্য এটিকে একটি পূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মর্যাদায় উন্নীত করেন।
দাউদ যুগ
১৯৫৩ সালে দাউদ খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক আরও অবনতি হয়। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কুনার প্রদেশ থেকে বাজৌর উপজাতীয় অঞ্চলে দুটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তান তাদের সামরিক ও বিমান বাহিনী ব্যবহার করে আক্রমণ দুটি প্রতিহত করে। এতে অপরপক্ষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
পাকিস্তান স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। পরে ১৯৬৩ সালের মে মাসে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে পাকিস্তানকে রাজি করানোর জন্য কিছু বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল।
তবে এই পরিস্থিতিতে উজবেকিস্তান থেকে কাবুল পর্যন্ত একটি বাণিজ্যিক সড়ক চালুর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। আর সালং হাইওয়ে নির্মাণে সহায়তার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে আফগানিস্তান। এর বদৌলতে প্রথমবারের মতো সোভিয়েতরা কাবুলে শক্ত অবস্থান তৈরি করে। যা পরে আফগানদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জহির শাহের পদত্যাগ
জহির শাহের নীতিতে সন্তুষ্ট না হয়ে তার চাচাতো ভাই দাউদ খান ১৯৭৩ সালের জুলাইয়ে সেনাবাহিনীর অনুগতদের দিয়ে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। জহির শাহ ওই সময় চিকিৎসার জন্য রোম সফরে ছিলেন। এদিকে দাউদ খান রাজ্য বিলুপ্ত করে আফগানিস্তানকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। আর নিজেকে আফগানিস্তার রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী হিসেবে দাউদ খান প্রাথমিকভাবে সোভিয়েতে সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ) থেকে কিছু কমিউনিস্টকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছিলেন। তবে পরে অন্যান্য দেশের সাথেও সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন।
তার ক্ষমতায় প্রথমদিকে, দাউদ খান দৃঢ়ভাবে পশতুনিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন। প্রকাশ্যে পাখতুন ও বেলুচ জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করেছিলেন। তাদেরকে কাবুলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গণ্য করেছিলেন। যা পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ওই সময় পাকিস্তানেও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ খাইবার-পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানে সমস্যা সৃষ্টির জন্য কাবুলকে দোষারোপ করে ইসলামাবাদ।
ওই সময় দাউদ খান ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করেন ও নেতৃস্থানীয় ইসলামপন্থীদের কয়েকজনকে পাকিস্তানে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়া। যিনি পরে তার নিজস্ব বিদ্রোহী গোষ্ঠী, হেজব-ই-ইসলামী আফগানিস্তান গঠন করেছিলেন। যারা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর অন্যান্য ইসলামপন্থীরাও একই পথ অনুসরণ করেন।
পাখতুন ও বেলুচ জাতীয়তাবাদীদের প্রতি দাউদের ক্রমাগত সমর্থন এবং সুপরিচিত রাজনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর হায়াত খান শেরপাওকে হত্যাসহ সন্ত্রাসী হামলার ধারাবাহিকতায় ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তার আফগান প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে আফগান ইসলামপন্থীদের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন।
স্পষ্টতই এর কিছু গভীর প্রভাব ছিল। উভয়পক্ষ শান্তির প্রস্তাব দেয়। ‘যুক্ত জমজদের’ মধ্যে সম্পর্ক আবার ঠিক হয়। দাউদ ও ভুট্টো উভয়ে ইসলামাবাদ ও কাবুলে সফর করেন।
সাওর বিপ্লব
তবে দাউদ খানের জন্য দেশে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিল। ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে একজন কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক হত্যার ফলে পিডিপিএর সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়েছিল। যার ফলে দাউদ খান মূল কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়েছিলেন। ওই সমফ নূর মোহাম্মদ তারাকী ও বাবরাক কারমালসহ শীর্ষ নেতাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয় এবং হাফিজুল্লাহ আমিনকে গৃহবন্দি করা হয়।
তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হতে পারে এই আশঙ্কায় দাউদ খান ১৯৭৮ সালের ২৬ এপ্রিল সামরিক বাহিনীকে উচ্চ সতর্কাবস্থায় রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, তিনি যাকে গৃহবন্দী করেছিলেন- হাফিজুল্লাহ আমিন ইতোমধ্যেই একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। এরপর ২৭ এপ্রিল, সৈন্যরা কাবুল মিলিটারি অ্যাকাডেমির কাছে তাদের ঘাঁটি থেকে সরে যায় এবং ২৮ এপ্রিল দাউদ খানের সব শেষ হয়ে যায়।
পিডিপিএ ক্ষমতা দখল করে। দাউদ খান ও তার পরিবারকে প্রেসিডেন্ট ভবনের ভেতরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। হামিদ কারজাইয়ের আমলে কাবুলের কুখ্যাত পুল-ই-চারখি কারাগারের দেয়ালের বাইরে দুটি গণকবরে তাদের গণকবেরর খোঁজ পাওয়া যায়।
এই অভ্যুত্থানকে সাওর বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। পিডিপিএ আফগানিস্তানকে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। নতুন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র শাসনের জন্য বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে তারাকী নামের একজন লেখককে মনোনীত করা হয়। কিন্তু তার শাসন ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকান-শিক্ষিত কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক হাফিজুল্লাহ আমিন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এর পরের মাসে তাকে হত্যা করা হয়।
এতে আমিনের ক্ষমতার মেয়াদ আরও সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ, সেনাবাহিনীর পদ ও ফাইলে দলত্যাগ এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের মৃত্যুদণ্ড তাকে পিডিপিএর প্রধান সমর্থক সোভিয়েতের কাছে দায়বদ্ধ করে তুলেছিল।
রেড আর্মির প্রবেশ
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে সোভিয়েতরা ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে। আমিনকে ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর কাবুলের সুরক্ষিত তাজবেগ প্রাসাদের ভেতরে হত্যা করা হয়। দাউদ ও আমিন উভয়ই তাদের নিজ নিজ মেয়াদের শেষের দিকে পাকিস্তানের সাথে আরও ভালো সম্পর্ক রাখতে চেয়েছিলেন।
সোভিয়েতরা মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ বাবরাক কারমালকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে আফগানিস্তানের শাসনভার হস্তান্তর করে। কারমাল খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। সোভিয়েত আগ্রাসন লাখ লাখ আফগানকে পাকিস্তান ও ইরানে শরণার্থী হিসাবে নির্বাসনে বাধ্য করেছিল। সেনাবাহিনীতে পলায়ন ও বিদ্রোহ একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে উঠেছিল।
সোভিয়েত আগ্রাসন কমিউনিস্ট বিরোধী প্রতিরোধের উত্থান ঘটায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট এবং সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সমর্থনে এটিকে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপান্তর করে। জেনারেল জিয়াউল হকের জন্য পশ্চিমাদের কাছে নিজেকে প্রিয় করে তোলার জন্য এটি ছিল সুবর্ণ সুযোগ।
আফগান জিহাদের রূপরেখা
'সম্প্রসারণবাদী' সোভিয়েতদের আরব সাগরের 'উষ্ণ জলরাশিতে' পৌঁছানো থেকে বিরত রাখতে জিয়াউল হক পশ্চিমের সাথে পাকিস্তানের সর্বোত্তম স্বার্থকে দক্ষতার সাথে যুক্ত করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ছিল ভিয়েতনামে পরাজয়ের প্রতিশোধ ও আফগানিস্তানে রুশদের মোক্ষম জবাব দেওয়ার সুযোগ। পারস্পরিক স্বার্থ আফগান জিহাদ নামে পরিচিতি লাভ করে।
পেশোয়ারভিত্তিক সাতটি ইসলামপন্থী প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। সৌদি আরবেরও অর্থায়ন ছিল। সিআইএ ও ব্রিটিশসহ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার একটি দল অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। যা শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী সোভিয়েতের পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছিল।
এই সময়ে আরও অশুভ কিছু ঘটেছিল। 'নাস্তিকদের' বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক সারা বিশ্ব থেকে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে উগ্র ইসলামপন্থীদের আকৃষ্ট করেছিল। মিশর ও আলজেরিয়া থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্য গোষ্ঠীরা পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে।
ফিলিস্তিনি তাত্ত্বিক আবদুল্লাহ আজম, মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ড. আয়মান আল-জাওয়াহিরি, ধনী সৌদি পরিবারের বংশধর ওসামা বিন লাদেন এবং অন্যান্যরা আফগানিস্তানে জিহাদ চালানোর জন্য পেশোয়ারকে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি বানিয়েছিলেন। যা কয়েক দশক পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিদ্রোহের মাত্রা ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং যুদ্ধের ব্যয় অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সোভিয়েতরা কারমালকে হঠানোর চেষ্টা করে। ক্রেমলিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালের মে মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ণ সমর্থনে কারমালকে অপসারণ করা হয়। তার পরিবর্তে আফগান গোয়েন্দা বিভাগের পাখতুন প্রধান ও ন্যাশনাল রিকনসিলেশনের চ্যাম্পিয়ন ড. মুহাম্মদ নজিবউল্লাহকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কারমালকে রাশিয়ায় নির্বাসিত করা হয়, যেখানে তিনি ১৯৯৬ সালে মারা যান।
মেডিকেল স্নাতক নজিবউল্লাহ কমিউনিস্ট মতাদর্শ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন, ইসলামকে সরকারি ধর্ম করার জন্য সংবিধানে পরিবর্তন করেন। নিজেকে আফগান জাতীয়তাবাদী হিসাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বড় পরিসরে জোট সরকার গঠনে আলোচনার জন্য মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলোর কাছে গিয়েছিলেন। পিডিপিএ সদস্য ব্যতীত আরও অনেককে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
এদিকে নজিবুল্লাহর গৃহীত পদক্ষেপগুলো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় আফগানিস্তানে আটকে পড়া সোভিয়েতরা আরও মরিয়া হয়ে উঠে। অবশেষে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার ফলে জেনেভা চুক্তি হয়। উভয়পক্ষই ১৯৮৮-৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে সম্মত হয়। এ চুক্তিতে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল আমেরিকা ও রাশিয়া।
ভবিষ্যদ্বাণীর বিপরীতে, নজিবুল্লাহর শাসন মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে। সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পরও টিকে ছিল, ভেঙে পড়েনি। প্রকৃতপক্ষে, এটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী শাহনওয়াজ তানাইয়ের একটি অভ্যুত্থানকে পরাস্ত করেছিল। ব্যর্থতার পর পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
রাশিয়ার সহায়তা শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পেরে নজিবউল্লাহ ১৯৯২ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘের পরিকল্পনার পথ প্রশস্ত করার জন্য রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদ এবং উজবেক মিলিশিয়া নেতা আব্দুর রশিদ দোস্তামের মধ্যে জোটের কারণে সামরিক অভ্যুত্থান শুরু হওয়ায় জাতিসংঘের পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি।
মুজাহিদিনরা যখন পাকিস্তান থেকে তাদের দেশে প্রবেশ করে, তখন কাবুল মাসুদ-দোস্তাম জোট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। নজিবউল্লাহ দিল্লিগামী বিমানে ওঠার জন্য বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে ধরা পড়েন। এভাবে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় পেশোয়ার চুক্তি নামে পরিচিত ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মুলা সত্ত্বেও মুজাহিদিন গ্রুপগুলোর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়।
তালেবানের আগমন
এই পরিস্থিতিতে সাবেক মুজাহিদিন কমান্ডার ও ধর্মীয় নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নেতৃত্বে তালেবানদের উত্থান ঘটে। পাকিস্তানের সমর্থনে তালেবানরা আফগানিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে কাবুলে প্রবেশ করে ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করে।
আফগানিস্তানের রাজধানীতে প্রবেশের পর তাদের প্রথম কাজ ছিল জাতিসংঘের কম্পাউন্ড থেকে ড. নজিবুল্লাহকে ধরে নিয়ে যাওয়া। তার ভাইসহ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা, তাদের ছিন্নভিন্ন লাশ কয়েকদিন ধরে খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখার পর টেনে নামিয়ে আনা।
আফগানিস্তানে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার দেখতে আগ্রহী পাকিস্তানই প্রথম তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেয়। ধর্মের কঠোর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে তাদের নীতি ও আল-কায়েদাসহ আন্তর্জাতিক জিহাদিদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত, শীঘ্রই আফগানিস্তানকে একটি পক্ষপাতদুষ্ট রাষ্ট্রে পরিণত করে। ৯/১১ এর ঘটনা আমেরিকানদের আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু মোল্লা ওমর তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পাকিস্তানকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিতে হয়েছিল।
শরণার্থী হিসাবে পাকিস্তানে বসবাসকারী রাজনীতিবিদ হামিদ কারজাইকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসাবে আনা হয়েছিল। ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা আশরাফ ঘানি তার স্থলাভিষিক্ত হন।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো ও সামরিক উন্নয়নের জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঢেলেছিল। কিন্তু আফগান তালেবানরা যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এসেছিল। পরবর্তীতে সংঘাতের ফলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয়ই ওয়াশিংটনের সাথে নতুন করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর ইসলামাবাদকে দ্বিমুখী আচরণের জন্য অভিযুক্ত করে কাবুল।
পাকিস্তান তাদের নিজস্ব মতবাদ অনুযায়ী তালেবানদের পরাস্ত করতে এবং একটি আইনবিহীন উপজাতীয় অঞ্চলকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনতে ধারাবাহিক সামরিক অভিযান শুরু করে। মার্কিনিরা পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের বেশি কিছু এলাকজুড়ে আল-কায়েদা ও তালেবান নেতৃত্বের সন্ধানে অবিরাম ড্রোন হামলা চালায়।
পাকিস্তান তার ইতিহাসের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেও, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট হাল ছেড়ে দেয়। যার ফলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানদের সাথে দোহা চুক্তি সম্পন্ন হয়। ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মুলা তৈরি না করেই ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ভবিষ্যদ্বাণীর বিপরীতে, তালেবানরা ২০২১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে কাবুলে প্রবেশের আগে বড় ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই একের পর এক প্রদেশ দখল করে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনী সরে গেলে, হেলিকপ্টারে চড়ে উজবেকিস্তান পালিয়ে যান আশরাফ ঘানি।
তালেবান পুনরায় কবুলের শাসনভার গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার ও মানবাধিকারের যে আন্তর্জাতিক দাবি সেটি আমলে নেয়নি। এই প্রেক্ষাপটে তালেবানদের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া পাকিস্তানের আর কোনো উপায় ছিল না। এরপর থেকে আবারও ‘যুক্ত জমজ' দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর সম্পর্ক চলতে থাকে।
- এই নিবন্ধটি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট। এরপর ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে পাকিস্তানের করা বিমান হামলার প্রেক্ষাপটে লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করে ডন। অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের খবরের সহসম্পাদক শিফা আক্তার বৃষ্টি।