Logo

মতামত

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক ও ভারতের মনোভাব

বেলায়েত হুসাইন

বেলায়েত হুসাইন

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:১২

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক ও ভারতের মনোভাব

ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতিতে ভবিষ্যত কোনো শত্রু-মিত্র নেই। একসময় যারা একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল কিন্তু পরে দেখা গেছে- তাদের মধ্যে বিদ্বেষের সেই প্রাচীর ভেঙে পড়েছে; তারা একে অপরের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের যে দেশগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একে অপরের প্রতিপক্ষ ছিল, তারা আজ অভিন্ন পাসপোর্ট ও মুদ্রা ব্যবহার করছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার ইতিহাস ও সম্পর্কের বিষয়টি ভিন্ন ও আলাদা। পাকিস্তান আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া একটি দেশের দুই অংশের মধ্যে বিদ্বেষের এমন বীজ বপন করা হয়েছিল, যা পূর্ব পাকিস্তানকে ক্রমেই বিচ্ছিন্নতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

এই পুরো ঘটনার পটভূমিতে পাকিস্তানের অবহেলা ও উদাসীনতার পাশাপাশি ভারতের জঘন্য চরিত্রকেও উপেক্ষা করা যায় না। তাদের এই হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের ফলাফল হলো- ১৯৭১ সালে একটি পাকা ফলের মতো ভারতের কোলে বাংলাদেশের আছড়ে পড়া। বিশেষত, বিগত দুই দশক যখন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তো এটাই মনে হচ্ছিল যে, বাংলাদেশ ভারতের একটি কলোনি। তবে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গোটা বাংলাদেশে আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং এর ফলে হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। 

এই পরিস্থিতিতে ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে শীতলতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। এমনকি হামলা হয় ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের কনস্যুলেটেও। আর এতে দেশ দুটির পারস্পরিক সম্পর্ক এমন এক উত্তেজনাকর পর্যায়ে উপনীত হয়, যা ভারত নিজেও আশা করেনি। পাশাপাশি বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রনীতিও ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অভিন্ন মনোভাবেরও দেখা মেলে। এবং এরই মধ্যে ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনা ওয়াজেদের প্রত্যর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির কাছে কূটনৈতিক অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তাদের পূর্ববর্তী পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করেছে। মনীষীদের নামও বদলে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ ইস্যুতে এসবের সঙ্গে ভারতের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো- দ্রুত গতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়া।   

আগস্টের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে অন্তত দুইবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মিয়া শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। অপরদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এখন পর্যন্ত তার কোনো সাক্ষাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে একটি বড় ধরনের টেলিকম চুক্তি বাতিল করেছে। বিপরীতে বাংলাদেশের বন্দরে নোঙর করেছে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক জাহাজ। এমনিভাবে দুই দেশের মধ্যে বেআইনি ইমিগ্রেশন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও পানি বণ্টন চুক্তির মতো সমস্যাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য ভিসা ফি বাতিল করেছে এবং চট্টগ্রাম থেকে করাচির দূরত্ব কমিয়ে আনছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বাণিজ্যের জন্য নতুন নতুন পথ তৈরির জন্য পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছেন। এক্ষেত্রে বিশেষত, টেক্সটাইল খাতকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। সেখানকার বাতাসে শোনা গেছে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানও। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও একসঙ্গে পথচলার সম্ভাবনার কথা ও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে শেখ হাসিনা ওয়াজিদ জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু মোহাম্মদ ইউনূস এই দাবি তোলেননি। ড. ইউনূসের ইতিহাসের গভীর অধ্যয়ন রয়েছে। তিনি জানেন যে, ১৯৭৪ সালে এই বিষয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছিল। যার অধীনে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর সফর করেছিলেন এবং জুলফিকর আলি ভুট্টো গিয়েছিলেন ঢাকায়। সেখানে বাংলাদেশিদের কাছে তিনি অতীতের তিক্ততা ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। 

আর যেই উন্নতির দিকটি ভারতকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে, তা হলো- পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতা। দুই দেশের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী। ২০২৫ সালে দুই দেশের বাহিনীর যৌথ মহড়ায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। আর ভারত এটি জানে যে, সামরিক প্রশিক্ষণ খুব সাধারণ কোনো বিষয় নয়; বরং এর মাধ্যমে দুটি দেশের সেনাবাহিনীর অফিসারগণ একত্রে বসে মতবিনিময় আদান-প্রদান করবেন। এতে তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করা হয়েছে, তার অবসান ঘটবে। সামরিক সহযোগিতা ভবিষ্যতে বৃহত্তর সহযোগিতার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। আর বাস্তবতা হলো- পাকিস্তান ও বাংলাদেশের খামির একই মাটি থেকে তৈরি এবং দুটি দেশের জনগণেই ভালোবাসা ও ইসলামি ভ্রাতৃত্বের চিরন্তন অনুভূতিতে আবদ্ধ। একটি সাময়িক বিরতি দুই দেশকে আলাদা করেছে বটে, তবে আজও তাদের মধ্যকার প্রেম-ভালোবাসা ভারতকে চিন্তিত ও বিষণ্ণ করে তোলে। 

আর এখন প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যৌথভাবে সার্ককে সক্রিয় করবে এবং পারস্পরিক প্রতিনিধি বিনিময় হবে। পাশাপাশি খুব শিগগিরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করবেন, যা একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য। সুতরাং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ শীঘ্রই বাংলাদেশ সফর করে আমলাতান্ত্রিক প্রতিনিধিদের পরিবর্তে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের তার প্রতিনিধি দলে নেওয়া। যাতে যৌথ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। মিয়া শাহবাজ শরিফ এবং ড. মোহাম্মদ ইউনূসের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক উপলক্ষ। এর সুযোগ নিয়ে তারা শুধু আঞ্চলিক রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করতে পারেন না; বরং ভারতের সম্প্রসারণবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও ধ্বংস করারও সক্ষমতা রয়েছে তাদের।

জিও নিউজের উর্দু ভার্সন থেকে পীর ফারুক বাহাউল হক শাহের কলাম সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের খবরের রিলিজিয়াস এডিটর বেলায়েত হুসাইন

বিএইচ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর