Logo

আন্তর্জাতিক

ভয়াবহ শীত

সন্তানদের বাঁচাতে এক অসম লড়াইয়ে গাজার মায়েরা

শিফা আক্তার বৃষ্টি

শিফা আক্তার বৃষ্টি

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৬

সন্তানদের বাঁচাতে এক অসম লড়াইয়ে গাজার মায়েরা

ছবি : সংগৃহীত

‘পাতলা কাপড়ের এই তাঁবুটি টিকিয়ে রাখা কঠিন। আমরা যত কাপড় পরি না কেন আর যত কম্বল গায়ে দিই না কেন তাঁবুর ভেতরে যখন বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়ে সেটা থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। বৃষ্টির পানি আমাদের বিছানা ও পোশাক ভিজিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা ও স্যাঁতসেতে অবস্থা বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের উপর বড় প্রভাব ফেলছে। বাচ্চাদের শুকনো ও নিরাপদ স্থানে রাখা প্রতিদিনকার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’-এভাবেই নিজেদের অবস্থা বর্ণনা করছিলেন ফিলিস্তিনের গাজার আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা ফিদা সুবাহ।

ফিলিস্তিনের আল-জাহরা শহর থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন সাত সন্তানের মা ফিদা সুবাহ (৩৯)। ইসরায়েলের চলমান সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়ে বর্তমানে একটি ভাঙা তাঁবুতে বাস করছেন। এই মাসে গাজায় তীব্র ঠান্ডা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চলছে ভারী বৃষ্টি। ছেঁড়া-ফাটা তাবুতে টিকে থাকা ফিদার মতো অসংখ্য মায়ের নিত্যদিনের সংগ্রামে পরিণত হয়েছে।

বাস্তুচ্যুত ১৯ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে ভঙ্গুর তাঁবু ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী ১৬ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির মধ্যে ফিদাও একজন। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংগঠন অ্যাকশনএইডের জন্য সাহায্যকারী হিসেবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ফিদা। তার মতো অন্য যারা একই রকম সংগ্রামের মুখোমুখি, তাদের জন্য সহায়তা ও ত্রাণ আনার চেষ্টা করেন ফিদা। নিজের পরিবারকে রক্ষার পাশাপাশি অন্যদের সাহায্য করার জন্য সবসময় প্রস্তুত। আর অকল্পনীয় চ্যালেঞ্জের মুখেও দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক ফিদা।

অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের তাঁবুগুলো অনেকটা পাতলা প্লাস্টিক শিটের মতোই। এই তাঁবুগুলো ঠান্ডা ও বৃষ্টির বিরুদ্ধে নিরাপদ রাখতে সক্ষম না। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ তাঁবুই ভারী বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যায় কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে শত শত অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র প্লাবিত হয়েছে। এতে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো আরও বেশি শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে।

ফিদার মতে, সংকটের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বিষয় হচ্ছে তার বাচ্চাদের উপর এর প্রভাব। তাদের সুস্থ রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ তাদের অসুস্থ করে ফেলছে। সঠিক যত্ন ও চিকিৎসার অভাবে গাজার শিশুরা আরও বেশি অসুস্থ হচ্ছে।

এ সম্পর্কে ফিদা বলেন, ‘বন্যা আরেকটি বড় সমস্যা। আমাদের সামান্য যা কিছু আছে তাও বন্যা ধ্বংস করে দিচ্ছে। একটি অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে। ভালো পরিবেশের ব্যবস্থা করার অক্ষমতা ও বাচ্চাদের কষ্ট পেতে দেখা আমাকে মানসিকভাবে কষ্ট দেয়। আমরা পরবর্তী ঝড় কাটিয়ে উঠতে পারব কিনা সে বিষয়ে আমি চিন্তিত।’

ফিদার অভিজ্ঞতা যেন গাজার আর সব মায়েদেরই প্রতিধ্বনি। দিনের পর দিন একই ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন গাজার মায়েরা।

ডালিয়া তার পরিবারের সাথে নুসেইরাতের সমুদ্র সৈকতে একটি তাঁবুতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার সন্তানরা ঠান্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমাদের পর্যাপ্ত ত্রিপল নেই... গতকাল আমরা বন্যায় ভেসে গিয়েছিলাম।’

আরেকজন মা মরিয়ম তাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, ‘আমরা এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে। তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের নিচে।এই তীব্র ঠান্ডায় আমার বাচ্চাদের নিয়ে ভয় হচ্ছে। আমাদের পর্যাপ্ত কম্বল ও কাপড় নেই। রাতে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে প্রচণ্ড বাতাসে তাঁবুটি ছিঁড়ে যায়। আমরা জেগে দেখি বিছানার সবকিছু ভিজে গেছে। আমার ছোট মেয়েও ভিজে গেছে। আমি তার জন্য পোশাক পাল্টাতে গিয়ে দেখি কাপড়ের ব্যাগও ভিজে গেছে।’

জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি গাজার শীতলতম মাস। নতুন বছরের শুরুতেই শীতের কারণে সাত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জরুরি সাহায্য না এলে আরও মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে গাজায় কোনোভাবেই সহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। গেল ডিসেম্বরে বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা সামগ্রী বহনকারী মাত্র ২৪টি ট্রাক মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। মাত্র ১৩৬ ট্রাক উত্তর গাজায় পৌঁছেছিল। এই সীমিত সহায়তার কারণে শীতের জন্য তাঁবু, কম্বল ও গরম পোশাকের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে বঞ্চিত হয় গাজাবাসী।

বিশ্ববাসীর প্রতি ফিদা সুবাহ আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন, পরিবার ও ভবিষ্যতের আশা নিয়েই সত্যিকারের মানুষ। ঠান্ডা, বন্যা ও বাস্তুচ্যুতি সাময়িক কষ্ট নয়; এগুলো চলমান সমস্যা, যা আমাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা ছিনিয়ে নিয়েছে। আমরা চাই বিশ্ব আমাদের দেখুক, আমাদের মানবতাকে স্বীকৃতি দিক ও আমাদের জীবন পুনর্গঠনে সহায়তা করার জন্য কাজ করুক।’

ফিদা দুই ধরনের সহায়তা প্রয়োজন জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের তাৎক্ষণিক যেসব সহায়তা দরকার সেগুলো হলো- আবহাওয়া উপযোগী তাঁবু, কম্বল, গরম পোশাক ও খাবার। এগুলো বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর দীর্ঘমেয়াদী সহায়তার মধ্যে রয়েছে- আমাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও অর্থনৈতিক সুযোগ। যা আমাদের বেঁচে থাকা থেকে শুরু করে আমাদের জীবন পুনর্নির্মাণে যেতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে দাঁড়ানো।’

অ্যাকশনএইড ফিলিস্তিনের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশনের কো-অর্ডিনেটর রিহাম জাফারি বলেন, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক হামলায় ফিলিস্তিনিরা কেবল মৃত্যুর ক্রমাগত হুমকির মুখোমুখিই হচ্ছেন না, সেখানে কোথাও তারা নিরাপদ নয়। তারা ঠান্ডা আবহাওয়া ও ভারী বৃষ্টিপাতের ঝুঁকিতেও রয়েছে। যা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সাহায্য আসতে না দেওয়ার অর্থ হলো- এর ফলে গাজাবাসী সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক জিনিস কম্বল, গরম কাপড়, পানিরোধী তাঁবু ও ত্রিপল পাচ্ছে না।’ 

তিনি আরও বলেন, শিশুরা ভেজা কাপড় পরে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় যাচ্ছে। কারণ তাদের বাবা-মায়ের কাছে তাদের শুকনো ও গরম রাখার কোনো উপায় নেই। বছরের শীতলতম সময়ে পরিস্থিতি কেবল আরও খারাপ হবে। আশ্রয় সামগ্রীর পাশাপাশি খাবার, পরিষ্কার পানি ও ওষুধ অবিলম্বে গাজায় ঢুকতে দিতে হবে।’

এই এনজিও কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘বোমা, ক্ষুধা ও হিমশীতল ঠান্ডা সত্ত্বেও, মানবিক সাহায্যকর্মীরা মানুষের মানবিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে। তবে তাদের মৌলিক সহায়তা প্রয়োজন। অ্যাকশনএইড গাজার উপর অবরোধের অবসান দাবি করেছে। আমরা গাজা উপত্যকায় মানবিক ত্রাণ সামগ্রীর অবাধ প্রবাহের আহ্বান জানাচ্ছি যেন এই শীতে আমাদের সহকর্মী এবং অংশীদারদের তাদের কঠিন কাজে পুরোপুরি সাহায্য করা যায়। আমরা অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছি।

ডালিয়া, মরিয়ম ও দারিনের পাশাপাশি ফিদা সুবাহর গল্পটি গাজার মায়েদের ধৈর্যের প্রতিনিধিত্ব করে। যারা অকল্পনীয় চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তাদের পরিবারের যত্ন নেওয়ার সব উপায় অবলম্বন করছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনীয়তার একটি শক্তিশালী বার্তাবাহক হচ্ছে তাদের অভিজ্ঞতা। অবরুদ্ধ গাজায় তাৎক্ষণিক সাহায্য ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ছাড়া শীত আরও বেশি প্রাণ কেড়ে নেবে। আর পরিবারগুলো হতাশার চক্রে আটকা পড়বে।

মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত লেখক তাসনিম নাজিরের লেখা অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের খবরের সহসম্পাদক শিফা আক্তার বৃষ্টি।

এসবি/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর