রম্য ভাবনা
শেখ হাসিনাকে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে দিল না যুক্তরাষ্ট্র!

আলিফ মিসকিন
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:২৫
-678d1a20bc419.jpg)
২০১৪ সালের ২৩ মার্চ প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘মদিনা সনদ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণের নির্দেশনা অনুসারে দেশ চলবে। এই সরকার পবিত্র কোরআন এবং সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করবে না।’- শেখ হাসিনার এই বক্তব্য শোনার পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় কাটিয়েছি যে, আসলে কবে আমরা মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছতে পারব। আমার মতো ইসলামপ্রিয় অসংখ্য মানুষ সেদিনের পর থেকে বাংলাদেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিলেন, কিন্তু একজন নারীই যে, দেশের মাটিতে এই মহান কর্ম আঞ্জাম দেবেন, তা কেউ ধারণাও করতে পারেননি। কিন্তু মহান আল্লাহ তাকেই নির্বাচন করেছিলেন।
এই বক্তব্য ও আনুসঙ্গিক নানা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আমি ফেসবুকে একটি লেখা লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল এরকম- ‘ইসলামপন্থীদের জন্য সুখবর, খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন শেখ হাসিনা।’ আমার এই লেখাটি ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুর দিককার। যার মূল বক্তব্য ছিল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে তার কন্যা শেখ হাসিনা ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য দেশে কতশত কাজ করেছেন; বাবার পক্ষ থেকে কাকরাইল মসজিদের জায়গা দান করা ও টঙ্গীতে ইজতেমা অনুষ্ঠানের জন্য সুবিশাল ময়দান ওয়াক্বফ করা থেকে শুরু করে সবশেষ কন্যার কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি ও দেশের প্রতিটি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ পর্যন্ত তাদের অসংখ্য অবদান। আসলে এগুলো ছিল ‘খেলাফত’ তথা মদিনা সনদ বাস্তবায়নের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ।
শুধু তাই নয়; বরং এই শেখ বংশের এ দেশে আগমনের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলেও দেখবেন যে, তাদের আগমনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম প্রচার করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপুরুষ শেখ আউয়াল ছিলেন বিখ্যাত বুযুর্গ হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর সমকালীন। তার সঙ্গেই পঞ্চদশ শতকে ইরাক থেকে বঙ্গে ইসলাম প্রচারের জন্য তার আগমন ঘটেছিল। সুতরাং বলাই যায়- প্রকাশ্যে যাই বলুক না কেন; বরং ওই রক্তেরই ফসল শেখ হাসিনা তলে তলে ইসলামের প্রচার-প্রসারই চান।
আমার ওই লেখাটিতে আরও স্পষ্ট করেছিলাম যে, ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান তো একজন নারী হতে পারেন না, কিন্তু তিনি এখনো ক্ষমতায়। যার কারণ ছিলো- আগে তিনি দেশকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত করবেন এবং এরপর খেলাফত ঘোষণা করে যোগ্য কারো ওপর রাষ্ট্রের দায়িত্বভার ন্যাস্ত করবেন। আমার এই বক্তব্যের শক্ত দলিল হলো- তিনি মুখে মুখে ‘গণতন্ত্র, গণতন্ত্র’ বললেও আসলে তিনি গণতন্ত্রকে কখনো পাত্তা দেননি। যা বোঝা যায়, তার শাসনামলের তিনটি নির্বাচন দেখে। যেখানে জনগণের কোনো রায় তিনি গ্রহণ করেননি; বরং খেলাফত রাষ্ট্রে যেভাবে ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’র (সভাসদগণ) অভিমত নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা ও ক্ষমতা গ্রহণ করা হয়, তিনিও সেটিই করেছেন। যদিও তার সভাসদ নির্বাচনে কিছুটা ত্রুটি দেখবেন। তবে আপনাকে এটাও দেখতে হবে যে, তিনিও রক্তেমাংসে গড়া একজন মানুষ।
ভারতসহ পৃথিবীর বড় বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের গভীর সম্পর্ক ছিল। দেশে গণতন্ত্র ঠিক রাখতে তাদের চাপও ছিল তার সরকারের ওপর। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের সেই চাপকে কোনো কেয়ার করেননি; বরং বিশেষত ভারতসহ ওই রাষ্ট্রগুলোকে বোকা বানিয়ে আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার দিকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এটা আরও স্পষ্ট হয় তার একসময়ের প্রতিপক্ষ আলেমদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক, ঘুম থেকে উঠে জায়নামাজ তালাশ করা এবং নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার মাধ্যমে।
কিন্তু তার দেড় দশকের দীর্ঘ সাধনা শেষ হয়ে যায় গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার আন্দোলনের ফলে। শেখ হাসিনার দাবি অনুযায়ী- যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ছাত্ররা তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে। তিনি এও বলেছেন যে, তার সরকার উৎখাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র দায়ী (১৮ জানুয়ারি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)। মানে তিনি বাংলাদেশকে যে ‘খেলাফত রাষ্ট্র’ বানানোর স্বপ্ন দেখতেন এবং মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার সেই স্বপ্ন ও আশা শেষ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে আমাদের জন্য আশার খবর হলো- ভারতে আশ্রিত আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি নতুন একটি বার্তা দিয়েছেন। যেখানে ৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছেন, ‘মাত্র ২০-২৫ মিনিটের ব্যবধানে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি আমরা। আমি ২১ আগস্টের হামলা থেকে বেঁচেছি। কোটালিপাড়ায় বোমা হামলা থেকে বেঁচেছি, ৫ আগস্টের হামলা থেকে বেঁচেছি। নিশ্চয়ই আল্লাহর ইচ্ছে রয়েছে। নয়তো আমি এবার বাঁচতাম না। তারা যেভাবে প্ল্যান করেছিল আমাকে হত্যা করার, সেটা পরবর্তীতে আপনারা দেখেছেন। তবুও এটা আল্লাহর একটা রহমত। আল্লাহ আমাকে দিয়ে আরও কিছু কাজ করাতে চান বলেই হয়তো আমি এখনো বেঁচে আছি (সমকাল, ১৮ জানুয়ারি-২০২৫)।’
হ্যাঁ, এটাই আমাদের জন্য আশা। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তাকে বারবার শত্রুর হামলা থেকে রক্ষা করেন, ভালো কিছু করার জন্য। আমরা তার প্রতীক্ষায় তিনি আবার আসবেন এবং এবার গণতন্ত্রকে পুরোপুরিভাবে হত্যা করে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করবেন। তবে এবার তার ‘খেলাফত’ কি মদিনা সনদে হবে নাকি প্রতিবেশীদের সনদে, তা সময়ই বলে দেবে। কারণ, তিনি এখন আর আলেমদের পরামর্শ নিচ্ছেন না, নিচ্ছেন বাংলাদেশের ‘আজন্ম মিত্র’র।
তবে আমার দুঃখ হচ্ছে তার একথা মনে করে যে, তিনি তার সর্বশেষ বার্তায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, ‘যদিও আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি আমার দেশছাড়া, ঘরছাড়া। তারা সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।’ আহ! তিনি যদি ফের আসেন, তাহলে তিনি কই থাকবেন? বিশ্লেষকদের মতে- পোড়া ঘর, ভাঙা ঘরে তাকে থাকতে দেওয়ার চেয়ে; নিরাপদ হবে কাশিমপুর কিংবা কেরানীগঞ্জের ‘সুরক্ষিত’ কোনো প্রাসাদে তার জন্য একটু জায়গা বরাদ্দ দেওয়া।