Logo

মতামত

সরকারের প্রতিশ্রুতির সমীকরণটি এখন কোথায়?

Icon

মো. মাহমুদ হাসান

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:৫৭

সরকারের প্রতিশ্রুতির সমীকরণটি এখন কোথায়?

৫ই আগস্ট ও তৎপরবর্তী ঘটনাসমূহ বাংলাদেশি সমাজ ব্যবস্থাকে একটি জটিল আবর্তে ফেলে দিয়েছে। একটি দীর্ঘস্থায়ী সরকারের দাম্ভিক ধারাবাহিকতাকে চুরমার করে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। শুরুতে সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূসের দায়িত্ব গ্রহণ জনমনে এক ভিন্নমাত্রার প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ নিজ নিজ প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকারের নীতি নির্ধারকদের ওপর নজর রাখছিল। 

‘দেশটি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার’! ‘আপনারা স্বাধীন, মন ভরে লিখুন। অনিয়ম অনাচারকে তুলে ধরুন, আমি খুব খুশি হব আমাকে চিঠি লিখুন’! এমন কথায়, প্রত্যাশা খুঁজে পেয়েছিল দিশেহারা মানুষ। শাসকদের রক্তচক্ষু যাদের তটস্থ করে রাখতো, সেই নিপীড়িত কলম সৈনিকরাও আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল। সরকারের মেয়াদ ছয় মাস পূর্ণ হতে আর মাত্র দু সপ্তাহ বাকি? জনপ্রত্যাশা আর সরকারের প্রতিশ্রুতির সমীকরণটি এখন কোথায়? 

গত সপ্তাহে এক সংবাদকর্মী সরকারের কাছে পাঁচটি চিঠি লিখার কথা উল্লেখ করেছেন! মানে ইউনূস সাহেবের কথায় আস্থা রেখে, পাঁচ মাসে পাঁচটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন! দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি কোন পত্রোত্তর পাননি! বিষয়গুলো সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, এমন কোনো লক্ষণও তিনি দেখতে পাননি। আরও কত শত মানুষের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে জানি না। আমি নিজেও এমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী। অবশেষে বুঝে নিলাম, সুন্দর সুন্দর ভাষায় বলা কথাগুলো পশ্চিমাদের হাসির মতো! এদের মুখ আর বুকের রূপ কখনো এক এক হয় না। ফায়ার করার আগেও, কৃতজ্ঞচিত্তে অবদানের জন্য ধন্যবাদ দেওয়ার মতো! 

যাহোক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন ইস্যুতে রাষ্ট্র ও সমাজে নানা রকম অস্থিরতা কাজ করে। ভেবেছিলাম, প্রকাশ্যে যা ঘটুক, লরিয়েটের সরকার হয়ত ৫৩ বছরের নিপীড়িত মানুষের মনের ভাষা বুঝেই কাজ করছে! বিধি বাম! সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানের একটি স্ট্যাটাস, আমার চিন্তার জগতের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। সংকটের উত্তরণ ঘটেনি, এটি আরও ঘনীভূত হয়েছে। এমন কথা শুনে, ভালোবাসার দেশটিকে নিয়ে হিসাব নিকাশে এক অদ্ভুত গন্ডগোল দেখা দিয়েছে! 

তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে নতুন নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যাই বলুক, অভিজ্ঞতা বলে আমজনতা তত্ত্বাবধায়কের আমলেই শান্তি খুঁজে পায়! দুর্নীতিবাজরা পালিয়ে বেড়ায়, পটকাবাজ, প্রতারকরা আতঙ্কে প্রহর গুনে। শাসকরা সেবকের রূপে জনতার পাশে দাঁড়ায়! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনতার প্রত্যাশা পূরণের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি। অলিউল্লাহ নোমানের স্ট্যাটাস, সেই ধারণাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। অনেকেই বলবেন, ফেসবুকে মানুষ কত কিছুই লিখে! একজন অলিউল্লাহ নোমানের স্ট্যাটাস এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো কেন? 

আমাদের দেশের সংবাদ জগতে দ্বিধা বিভক্তি আছে। নানা মত,পথের মানুষের সমাহারে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তারকা সাংবাদিকদের সম্পদের বিবরণী শুনলে, চমকে যেতে হয়। গাড়ি, বাড়ি আর চলনে বলনে, এরা তৃতীয় বিশ্বের সাংবাদিক, এটি বোঝা দুষ্কর! এত অনাচারের মাঝেও কিছু কিছু মানুষ অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আজকাল বড় বড় সাংবাদিক নেতা আর তারকা খ্যাতি পাওয়া জার্নালিস্টদের কথাবার্তা আমায় খুব টানে না। তবে শওগাত আলী সাগর, শরিফুল হাসান আর অলিউল্লাহ নোমানকে নিয়মিত ফলো করি। এঁরা তিনজন একই মত পথের মানুষ, এমন নয়। তবুও একটি বিষয়ে তিনজনের মাঝে দারুণ মিল খুঁজে পাই। এঁরা প্রত্যেকেই নির্লোভ, আর সততায় দারুণ নির্ভীক। তাই অলিউল্লাহ নোমানের সাম্প্রতিক স্ট্যাটাসটি আমার মনবেদনার কারণ হয়েছে! 

প্রতি ঘণ্টায় হাজার হাজার লাইক, শত শত শেয়ার। চব্বিশ ঘণ্টায় শেয়ারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে! কী লিখেছেন নির্বাসন ফেরত অলিউল্লাহ নোমান? দেশে কয়েক সপ্তাহ ব্যস্ততম সময় কাটিয়ে তিনি গত ১৬ জানুয়ারি লন্ডন ফিরছিলেন। পথিমধ্যে শুভানুধ্যায়ী, ফ্যান ফলোয়ারদের উদ্দেশ্যে একটি ফেসবুক পোস্ট করেন। তিনি লেখেন, “শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন এটুকুই শান্তি। বাকী সব আগের চেয়েও অবনতি হয়েছে। বদলি, পোস্টিংয়ে টাকার ছড়াছড়ি। ঘুষ, দুর্নীতি কোন কোন ক্ষেত্রে বেড়েছে। লুটেরা, চাঁদাবাজ শুধুমাত্র চেহারার পরিবর্তন হয়েছে। চাঁদার রেট কোন কোন জায়গায় বেড়ে গেছে আগের তুলনায়। ফাইল আগের মতই আটকে থাকে ঘুষের অপেক্ষায়। বিপ্লব বলতে যা বোঝায় তার ধারেকাছেও কিছু নেই। এত রক্ত ও শহীদের আত্মা আমাদের অভিশাপ দিবে।”

আওয়ামী শাসনামলে একযুগেরও বেশি সময় নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন অলিউল্লাহ নোমান। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। চিন্তা, চেতনা, মত,পথে ভিন্নতা থাকলেও তার সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আর ভিন্ন মতের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ সে তো অতুলনীয়! ৫ই আগস্টের পর দীর্ঘ নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে ফুলেল শুভেচ্ছায় সংবর্ধিত হয়েছেন। এটি তার প্রাপ্য। বিশ্বাস ছিল, পরিবর্তন প্রত্যাশী অন্তর্বর্তীকালীন শাসকদের কার্যকলাপে অলিউল্লাহ নোমানদের চিন্তা চেতনা ও দর্শনের প্রতিফলন ঘটবে! দুদিন আগে তার স্ট্যাটাসে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন ‘আমি হতাশ’! 

এ সরকারের আমলে অলিউল্লাহ নোমানরা হতাশ হবেন কেন? তাহলে কি দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন বিরোধী বক্তৃতা বিবৃতি সবই ছিল গাল গল্প! আর এসব যদি আষাঢ়ে গল্পই হয়, তবে সমাজ পরিবর্তনের ভাবনাটি কি আসলেই অসম্ভব? শুধু কি শাসক পাল্টাতেই রক্তের হোলি খেলা! এক স্বৈরাচারকে পাল্টিয়ে নতুন স্বৈরাচারের জন্ম দেওয়া তো লক্ষ্য ছিল না। যদি দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারেন, শুধুমাত্র গণভবনকে জাদুঘর বানালেই কি জুলাই বিপ্লবে আত্মদানকারীদের অন্তরাত্মা শান্তি পাবে? হ্যাঁ পাঠক, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই অনুসন্ধানী সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানের স্ট্যাটাসটি পাঠকের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

  • লেখক : কলামিস্ট ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক 
    ই-মেইল : [email protected]

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর