
তিস্তা মহাপরিকল্পনা কি বাস্তবায়ন হবে? নাকি আদৌ হবে না? এই প্রশ্ন এখন নীলফামারী জেলার মানুষের সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী নীলফামারী জেলার তিস্তা তীরবর্তী ডিমলার উপজেলার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে সরকার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক টানাপোড়নে হারিয়ে গেছে এই পরিকল্পনা।
এদিকে, তিস্তার পানি বণ্টনে চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ শ্লোগানে ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচির পালন করছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। এই কর্মসূচির দুইদিন আগে আকস্মিকভাবে ধু-ধু বালুচরে দেখা দিয়েছে উজানের ঢল।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, হঠাৎ দুই-তিনি আগ থেকে পানি একটু একটু করে বাড়তে থাকে। রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৬টায় ব্যারাজ পয়েন্টে পানি পরিমাণ ছিল ৫০ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার। কিন্তু ওই পয়েন্টে বন্যার পানির পরিমাপ (৫২.১৫) সেন্টিমিটার।
চীনের হোয়াংহো নদী, এক সময় ছিল চীনের মানুষের দুঃখের কারণ। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ হতো বাস্তুহারা, ধ্বংস হয়ে যেত গ্রামগঞ্জ ও জীববৈচিত্র। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে। নদী শাসনের মাধ্যমে হোয়াংহো এখন মানুষের পরম বন্ধু। এই সাফল্যের ভাগীদার বাংলাদেশও একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বারবার শুনলেও আটকে আছে পরিকল্পনাতেই। নেই কোনো তৎপরতা।
রংপুর বিভাগসহ তিস্তা তীরবর্তী মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই প্রকল্পটি কবে বাস্তবায়িত হবে? নাকি আদৌও হবে না। রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের কল্যাণে ও বানভাসি মানুষের দুঃখের কথা ভেবে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা কি সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে?
এদিকে, ২০২২ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং তিস্তা নদীর নীলফামারী জেলার ডিমলা ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা সেচ প্রকল্প পরিদর্শনে আসেন। তিস্তাকে ঘিরে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে পূর্ব চিনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তা ব্যারাজকে গড়ে তোলা হবে। চীনা রাষ্ট্র দূতের এমন কথা ও পরিদর্শন তিস্তা পাড়ের বানভাসি মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছিলেন। তার এই পরিদর্শনকে তিস্তা মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তিস্তা পাড়ের মানুষ ভেবেছিল, এবার তাদের দীর্ঘদিনের দুঃখের অবসান শেষ হবে। কিন্তু তার পরিদর্শন ও পরিকল্পনা আজও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে তিস্তা পাড়ের মানুষ হতাশায় ভুগছে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে লাখো মানুষের দুর্ভোগের অবসান হবে। এই আশায় তিস্তা পারের বাসিন্দারাসহ নীলফামারী জেলার ডোমার, ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার লাখো পরিবার আনন্দের জোয়ারে ভাসছে।
ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা মফেল উদ্দিন (৫৫) বলেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন হলে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো। মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু হারাবার চিন্তা থেকে মুক্তি পাবো। ডাল ভাত খেয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। পরবর্তী প্রজন্ম সুখী সমৃদ্ধশালী জীবন ফিরে পাবে। সাথে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশও।
উপজেলার ঝাড়সিংহশ্বর চরের কৃষক আফাজ উদ্দিন (৬৫) বলেন, ‘২০২২ সালে শুনছি তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা, কিন্তু বাস্তবায়ন কবে হবে জানি না। বর্ষা এলে ঘরপোড়া গরুর মতো পরিবার পরিজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। হারিয়ে যায় বীজতলা, ফসলি জমি, পুকুরের মাছ ও বসতবাড়ি। নদী ভাঙনের কারণে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছি। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি ডিমলাবাসীর জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার অনুরোধ জানাই।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় প্রত্যেক বছর ড্রেজিং এর নামে কোটি কোটি টাকা হরিলুট করা হয়। কিন্তু খরা মৌসুমে তিস্তা শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। জেলেরা তাদের পেশা হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এক সময়ের পালতোলা নৌকা ও মাঝি-মাল্লার হাঁকডাক হারিয়ে গেছে। ভাটা পড়েছে তাদের পেশাগত জীবনে। দেশ বিদেশ থেকে নদী পথে বাণিজ্য করতে আসতো সওদাগররা। এখন সেই তিস্তা নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। চোখে পড়ে শুধু বালু আর বালু। মনে হয় মরুভূমি।
সূত্র জানায়, বছরের পর বছর তিস্তা নদীর ভাঙনে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলার প্রায় দেড় কোটি মানুষের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে তোলে। বিশেষ করে জেলার ডিমলা, ডোমার ও জলঢাকার মানুষ ভাঙনের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ কার্লভাট, স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা মসজিদসহ নানা অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় হাজার হাজার স্কুলগামী শিশুদের লেখাপড়া। এগুলি পুনর্বাসনে বেগ পেতে হয় সরকারকে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল আলম বলেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুধু তিস্তার পারের মানুষের দাবি নয়, এটি রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলার মানুষের দাবি। আমরা ভারত, চীন বুঝি না, যেভাবেই হোক তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন চাই। প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার অনুরোধ জানাই।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অব চায়নার মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে এই মহাপরিকল্পনার যাত্রা শুরু হয়। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সজ্জিত শহর গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ডালিয়ায় এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার কথা।
তৈয়ব আলী সরকার : সাংবাদিক; নীলফামারী প্রতিনিধি, বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমএইচএস