Logo

রাজনীতি

দৃষ্টি সবার এনসিপিতে

সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠাই চ্যালেঞ্জ

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১১:৪৪

সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠাই চ্যালেঞ্জ

সর্বত্র আলোচনায় জুলাই-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-তরুণদের নতুন দল নিয়ে। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই, দেশজুড়ে সাংগঠনিক বিস্তার ঘটাতে চাইছে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শুক্রবার আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলটি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচনই প্রধান লক্ষ্য উল্লেখ করেছে। তাই এনসিপির পরবর্তী কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি রাজনৈতিক অন্য দলগুলোর। সব মিলিয়ে এনসিপি রাজনীতি ও নির্বাচনে বিএনপির নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থানের ইঙ্গিত মিলছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন দলটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ঐক্য চান। প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান হবে না।

যদিও তাদের লক্ষ্যগুলো খুবই ভালো, তবে সার্বিকভাবে দেশে এ বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করাই চ্যালেঞ্জ। কারণ, তারা আগামী দিনগুলোতে কী ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করবে, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণে ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠায় ন্যূনতম যে জাতীয় ঐক্য দরকার, সে ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।

৫ আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি নতুন রাজনৈতিক দলের গুঞ্জন উঠে। অভ্যুত্থান চলাকালে এর নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা ঘোষণায় একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ ছিল।

এরপর সেপ্টেম্বরে দেশ পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। ডিসেম্বর জানা যায় যে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন দল গঠন করা হবে এবং সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসে এবং ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে রাজনৈতিক এনসিপি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ছাত্র-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল। এটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার ফলাফল। 

প্রতিষ্ঠার পর এনসিপি নেতারা জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলেও চাঁদাবাজি, দখল ও অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়ে গেছে, যার অধিকাংশ অভিযোগ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। নির্বাচনের মাঠে দলটিকে মোকাবিলায় এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান ও জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাবে তারা। গ্রামগঞ্জে ইস্যুগুলো নিয়ে যাবেন এনসিপির নেতারা।

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদিত হয়েছে। গতকাল রোববার জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের পাঠানো এক বার্তায় বিষয়টি জানানো হয়েছে।

বার্তায় বলা হয়, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে বাংলাদেশের নাগরিকরা মুক্ত হয়েছে। তবে শহীদ মিনারে ঘোষিত অভ্যুত্থানের এক দফা তথা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে এই জনপদের মানুষ ইতিহাসের নানান সময়ে নিজেদের হাজির করেছে। প্রায় ২০০ বছরের উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের অংশ হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা ১৯৪৭ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করি। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র এই জনপদের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আরও বলা হয়, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে এই জনপদের মানুষ ১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে প্রণীত মুজিববাদী সংবিধানের মধ্য দিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিয়েছে। যার ফলে এ দেশের নাগরিকরা ইতিহাসের বিভিন্ন পরিক্রমায় বাকশাল, স্বৈরতন্ত্র এবং সর্বশেষ ফ্যাসিবাদের শিকার হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো থেকে ফ্যাসিবাদের সব উপাদান ও কাঠামোকে বিলোপ করতে এবং এই জনপদের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আমরা, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা, ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করেছি।

জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম বীর যোদ্ধা শহীদ ইসমাঈলের বোন মিম আক্তার জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন। উক্ত আহ্বায়ক কমিটি (আংশিক) আগামী এক বছরের মধ্যে এই রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র ও ইশতেহার প্রণয়ন, কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সাংগঠনিক বিস্তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

অন্যদিকে এনসিপির যাত্রা শুরু হয়েছে ১৭১ সদস্যের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির মধ্য দিয়ে। তবে এ কমিটির আকার শিগগিরই বেড়ে দুই শতাধিক সদস্যের হতে পারে বলে জানিয়েছেন দলটির দায়িত্বশীল দুই নেতা। দলের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোর বাইরে ১৬ জনকে যুগ্ম আহ্বায়ক, ৩২ জনকে যুগ্ম সদস্যসচিব, ২৬ জনকে দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক, ১৮ জনকে উত্তরাঞ্চলের সংগঠক, ১৪ জনকে যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও ৪৩ জনকে সদস্য করা হয়েছে।

এদিকে এনসিপি আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতা বক্তব্যের ইতি টেনেছেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি দিয়ে। এ স্লোগান দলীয় কি-না তা নিয়ে চলছে বিভিন্ন মহলে আলোচনা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দল গঠনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের অনেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি ব্যবহার করতেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে একই স্লোগান অনেক নেতা ব্যবহার করায় কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে স্লোগানটি কি জাতীয় নাগরিক পার্টি দলীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক জাফর আহমেদ ভূঁইয়া জানান, ইনকিলাব আরবি শব্দ। জিন্দাবাদ উর্দু শব্দ। মানে হলো ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি আরবি ও উর্দুর মিশেল। জিন্দাবাদ মানে অভিনন্দন জানানো। ফলে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের মানে হলো বিপ্লবকে অভিনন্দন জানানো।

জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, এটি জাতীয় নাগরিক পার্টির দলীয় স্লোগান নয়। যেহেতু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি বেশ আলোচিত ছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এখনো আমরা এই স্লোগানটি বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যবহার করছি। আমাদের দলীয় স্লোগান ও মূলনীতি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত আত্মপ্রকাশ, কমিটি প্রকাশ আর ঘোষণাপত্র হয়েছে। বাকি বিষয়গুলো সামনে চূড়ান্ত করা হবে। এছাড়া দলটির মূল লক্ষ্য তৃণমূলে বিস্তৃতি। দলীয় প্রতীক নির্ধারণে হবে জরিপের মাধ্যমে। 

এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিক বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রাজনীতির চর্চা এবং এর বিকাশ ও বিস্তার যত বেশি হয়, ততই ভালো। তাদের আত্মপ্রকাশে খুশি হয়েছি, আশাবাদীও হতে চাই। কারণ, তারা সেই শক্তি, যারা চব্বিশে অসাধ্যকে সাধন করেছে। তবে সরকার উৎখাতের আন্দোলন ও দেশকে বদলে দেওয়ার আন্দোলন এক জিনিস নয়। এটা অনেক বেশি পরিমাণে জ্ঞানের, অভিজ্ঞতার লড়াই।

তিনি বলেন, দেশ বদলে দেওয়ার জন্য সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ১৫টি সংস্কার কমিশন হয়েছে। ছয়টি কমিশন রিপোর্টও জমা দিয়েছে। এই রিপোর্টগুলো পড়লে বোঝা যায়, কতখানি জানতে হবে, কত জ্ঞান দরকার। তবে ছাত্র-তরুণেরা যে ধরনের ঘোষণা দিয়ে সামনে এসেছে, সেটা রক্ষা করতে পারলে তারা একটা গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নতুন একটি দল আত্মপ্রকাশ করেছে। আগামীতে আরও রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হতে পারে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা থাকে। এই চিন্তা-চেতনা থেকে সবাই প্রতিশ্রুতি দেবেন এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনগণের কাছে যাবেন। এমন সুস্থ গণতন্ত্রের জন্যই আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর লড়াই-সংগ্রাম করেছি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তরুণরা যে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন-জনগণ তা ইতিবাচক হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অতীতের নতুন কোনো রাজনৈতিক দল নিয়ে মানুষের এত বেশি আগ্রহ প্রত্যাশা তৈরি হয়নি। এবার জাতীয় নাগরিক পার্টি নিয়ে যেমনটা তৈরি হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা প্রতিক্রিয়া যেভাবে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে হয়, তেমনটা হচ্ছে এই দল নিয়েও। এই দল নিয়ে মানুষ ভীষণ আগ্রহ দেখাচ্ছে। এজন্য জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নতুন রাজনৈতিক দলটির আত্মপ্রকাশকে আমি খুবই ইতিবাচক হিসাবে দেখছি। আশা করছি এটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক দল হবে। তারা সব আইন-কানুন বিধি-বিধান মেনে চলবে। এই দলটি অবশ্যই মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। আমাদের এখানে একটা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকে, ভিন্ন মত থাকে। আমি আশা করব সব মতের সমন্বয় ঘটিয়ে দলটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করবে।

  • ওএফ
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর