
প্রথম দলীয় কর্মসূচিতে মঙ্গলবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এনসিপির নেতারা। ছবি : বাংলাদেশের খবর
চলার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান। আর হাসিনার পতন থেকে সরকার গঠন। ৬৫০-এর অধিক মানুষের জীবনের বিনিময়ে, নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-জনতা।
এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গঠনের পর, আবার নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব। এখন দলটির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ দলের সদস্য সংগ্রহ, জেলা-উপজেলায় কমিটি এবং কার্যালয় স্থাপন। তাই পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই বলে মনে করছেন শীর্ষ নেতারা।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোট করার লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে এনসিপি। তাই এ নির্বাচনের আগে, নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধনভুক্ত হতে মাঠে নেমে পড়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
তারা বলছেন, এখন তারা তিনটি লক্ষ্য পূরণের জন্য এগোচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম লক্ষ্য তৃণমূলে সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম বিস্তৃতি করা। দ্বিতীয় লক্ষ্য ইসির নিবন্ধন নিতে যে ধরনের শর্ত পূরণ করতে হয় সেগুলো পূরণ করা। তৃতীয় লক্ষ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ করে নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বই দশকে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের পর রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিকশিত হয়েছে। চব্বিশের গণআন্দোলনের পরও একই আকাঙ্ক্ষা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিপির সামনে এখন প্রধান লক্ষ্য নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনভুক্ত হওয়া। শর্ত অনুযায়ী, ২১টি জেলা ও ১০০ উপজেলায় থাকতে হবে কমিটি ও দলীয় কার্যালয়।
শুরুতেই চ্যালেঞ্জিং এই লক্ষ্য অর্জনের কাজে মনোনিবেশ করেছে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম। ডান, বাম, শিবির, কওমিসহ বিভিন্ন ধারা থেকে আসা তরুণ ছাত্রনেতা ও বিভিন্ন পেশাজীবী নিয়ে গঠিত এনসিপি আত্মপ্রকাশের সময়, নিজেদের মধ্যপন্থি ভাবধারার বলে ঘোষণা দিলেও, মধ্য-ডানপন্থি আদর্শ ধারণ করবে।
দলটির নেতারা নিজেদের পরিচিত করাবেন বাংলাদেশপন্থি হিসেবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
এনসিপির আহ্বায়ক কমিটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দল আত্মপ্রকাশের আগে থেকেই গঠনতন্ত্রসহ দলের স্লোগান, লোগো, নির্বাচনী প্রতীক ও কর্মসূচি নির্ধারণ নিয়ে পুরোদমে কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে দলের প্রতীক হিসেবে কলম, বই, বাঘ ও ইলিশ নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
দলের জেলা, উপজেলা কমিটি গঠন ও অফিস প্রতিষ্ঠা করে চলতি মাসের মধ্যেই নিবন্ধনের আবেদন করতে চান তারা। আর চলতি মাসে দল গুছিয়ে উঠতে পারলে এপ্রিলেই স্থানীয় নির্বাচন, গণপরিষদ নির্বাচন, নতুন সংবিধানের দাবি ছাড়াও বিভিন্ন জনদাবিতে রাজপথে নামবে এনসিপি। বিভাগীয় সমাবেশ, লংমার্চসহ বেশ কিছু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে দলটির মধ্যে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, কমিটি গঠন নিয়ে আমাদের সংগঠক টিম ধারাবাহিক বৈঠক করছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিগুলো কীভাবে দলের কমিটিতে আনা যায়, সে পলিসি ঠিক করছে তারা। সেটা চলতি রমজান মাসের মধ্যেই শেষ হবে। দলের গঠনতন্ত্র তৈরির কাজও এ মাসের মধ্যে শেষ করবেন বলে জানান তিনি।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, রাজনীতিতে সবার দৃষ্টি তৃণমূলের দিকেই থাকে। আমরা মূলত সব স্তরের মানুষকে যুক্ত করতে চাই। আমরা শুধু ভোটের জন্য রাজনীতি করব এমনটা নয়। তাদের ভোটার হিসেবে ট্রিট (বিবেচনা) করছি না। যেহেতু সাধারণ মানুষের নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ আমাদের নিয়ে কী ভাবছে সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
তিনি জানান, আমাদের দল গোছানোর কাজ চলমান রয়েছে। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকবেন এনসিপি নেতাকর্মীরা তৃণমূল পর্যায়ে কার্যক্রম আরও বেগবান করতে ও সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতে চলতি মাসের মধ্যেই জেলা-উপজেলা কমিটি গঠনের কাজ শেষ করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এরই মধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির দেশজুড়ে ঘোষিত সাড়ে চারশোর বেশি কমিটির সদস্যদের এনসিপিতে যুক্ত করা হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোট করার লক্ষ্য নিয়েই দল গোছাচ্ছেন তারা।
যদিও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে এখনো রাজনৈতিক সুরাহা না হলেও অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ বছরের ডিসেম্বরকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে।
ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া নির্বাচন কমিশনের রুটিন কার্যক্রম। অক্টোবরে যদি সংসদ নির্বাচনের তফসিল হয়, তাহলে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করতে হবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া আছে, তা হলো ন্যূনতম ২১ জেলা ও ১০০টি উপজেলায় কমিটি ও কার্যালয় থাকতে হবে। পাশাপাশি, প্রতিটি উপজেলা সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ ভোটারের অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে।
এসব কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে দলের নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েক দিনের মধ্যে দলীয় ফোরামের ব্যস্ততা শুরু হবে বলে জানান এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, আমাদের ৩০০ আসন টার্গেট করে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালিত হবে। তাই একটা পার্টিকে রেজিস্ট্রেশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য যে ধরনের শর্তাবলি রয়েছে, আমরা বিশ্বাস করি মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে এই শর্তাবলি পূরণ করতে পারব।
তবে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাস্তবতায় রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত আরও শিথিল করার পক্ষে মত রয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের। কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম বলেন, বর্তমানে নিবন্ধনের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া আছে এগুলোকে একটু শিথিল করার চেষ্টা করেছি। এখন ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ উপজেলায় কার্যালয় ও একই সঙ্গে সর্বনিম্ন ৫ হাজার সদস্য থাকে তাহলে আমরা তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছি।
বিকেপি/এমএইচএস