Logo
Logo

ধর্ম

আল্লামা কামরুদ্দিন আহমদ গৌরখপুরি রহ. : জীবন ও কর্ম

Icon

মুফতী মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৯

আল্লামা কামরুদ্দিন আহমদ গৌরখপুরি রহ. : জীবন ও কর্ম

জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা
হযরতের পূর্ণ নাম কমরুদ্দিন আহমদ গৌরখপুরী। তিনি আল্লামা কমরুদ্দিন নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ১৯৩৮ সালে ভারতের পূর্ব উত্তর প্রদেশের গৌরখপুর জেলার বাঢ়ালগঞ্জ এলাকায় তার জন্ম। হযরতের পিতা মরহুম হাজী বশীরুদ্দীন সাহেব ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে স্থানীয় দেওবন্দী মাদরাসায় ভর্তি করেন। সেখানে মাওলানা সফিউল্লাহ কাসেমীর কাছে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা 
এরপরে এক বছর এহয়াউল উলূম মোবারকপুর মাদরাসায় পড়াশোনা করে পূর্ব উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম মৌ-তে ভর্তি হন। মুল্লা হাসান, মুতানাব্বী, মুখতাসারুল মা'আনী এবং হেদায়া আওয়ালাইন এখানেই পড়েন।

উচ্চ শিক্ষা 
অতঃপর উচ্চ শিক্ষাসহ অবশিষ্ট পড়াশোনা সম্পন্ন করার জন্য ১৯৫৪ সালে এশিয়া উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দ্বীনি বিদ্যাপীঠ, ঐতিহ্যবাহী দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। তখনকার আসাতিযায়ে কেরামের কাছে পড়াশোনা করে ১৯৫৮ ঈসাব্দে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। তিনি শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)-এর কাছে বুখারী শরীফ পড়া আরম্ভ করেন এবং ঐ বছর (৫ ডিসেম্বর-১৯৫৭) হযরত মাদানীর ইনতিকাল হলে হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ.)-এর কাছে ১৯৫৮ সালে বুখারী শরীফ সম্পন্ন করেন। এজন্য নিজেকে যিন্নুরাইন বলে সম্মানিতবোধ করতেন। অর্থাৎ দুই নূরের অধিকারী,তথা দুই মহান শায়খের শিষ্যত্ব লাভকারী। 

এরপরে আরও ২ বছর পর্যন্ত তাকমীলে ফুনুন নামক উচ্চতর বিশেষায়িত ডিগ্রি অর্জন করেন। উন্নত চরিত্রের অধিকারী, প্রচণ্ড মেধাশক্তি এবং স্বভাবজাত বিনয়-নম্রতার কারণে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়পাত্র।

হযরতের বুখারী শরীফের উস্তায ছিলেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও ফখরুল মুহাদ্দিসীন  হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী, মুসলিম ও তিরমীযির উসতায ছিলেন আল্লামা ইবরাহীম (বালিয়াভী রহ.), নাসাঈ শরীফের উসতায ছিলেন মাওলানা বশীর আহমাদ খান বুলন্দশহরী, আবু দাউদের উসতায ছিলেন মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী, শামায়েলে তিরমীযির উসতায ছিলেন মাওলানা আবদুল আহাদ দেওবন্দী, তহাবী শরীফের উসতায ছিলেন মাওলানা সাইয়েদ হাসান দেওবন্দী। এছাড়া মুআত্তা মালেক  ও ইবনে মাজাহ শরীফের উসতায ছিলেন হযরত মাওলানা জহুর আহমদ দেওবন্দী, মুআত্তা মুহাম্মাদের উসতায ছিলেন হযরত মাওলানা জলীল আহমাদ কিরানভী এবং মুসালসালাতের উসতায ছিলেনশায়েখ যাকারিয়া কান্ধলভী ও কারী তৈয়ব কাসেমী। এছাড়াও সকল কিতাবের এজাযত দিয়েছিলেন মুহাদ্দিসে কাবীর আবুল মাআছির হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী (রহ.)।

কর্ম জীবন 
১৯৬১ সালে আল্লামা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.)-এর নির্দেশ ক্রমে হযরত আল্লামা কামরুদ্দিন আহমদ গৌরখপুরি (রহ.) দিল্লির ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ মাদরাসা আবদুর রব কাশমীরি গেটে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। প্রায় ৭ বছর শিক্ষকতায় দরসে নেযামীর অধিকাংশ কিতাবাদি তিনি পাঠদান করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি দিল্লির এক জামে মসজিদে কোরআনে কারীমের তাফসীরও করতেন। 

দারুল উলূম দেওবন্দে নিযুক্তি 
১৯৬৬ সালে আল্লামা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.)-এর প্রস্তাবে তিনি এশিয়া উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দ্বীনি দরসগাহ ঐতিহ্যবাহী দারুল উলূম দেওবন্দের উসতায হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অস্থায়ী নিয়োগের মাত্র ৬ মাসের মাথায় আল্লামা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.) আল্লামা গৌরখপুরির চমৎকার পাঠদান, জনপ্রিয়তা এবং অভাবনীয় কর্মতৎপরতার কারণে তাকে স্থায়ী নিয়োগ দান করেন এবং তৎকালীন নাযিমে তা’লীমাত মাওলানা আখতার হুসাইন দেওবন্দীকে আলামা কামরুদ্দিনের দ্রুত প্রমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। 

এজন্য মাত্র ১২ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে সহকারী শিক্ষক থেকে তার সিনিয়র উসতায পর্যন্ত পদোন্নতি হয়ে যায়। 

তিনি দীর্ঘ ৫৮ বছরের শিক্ষকতার জীবনে দারুল উলূম দেওবন্দে উলূমে আরাবিয়া, মানতিক-ফলাসাফা, হাদীস-তাফসীর, কালাম-ফিকহ, উসুল-আকায়িদ ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিতাবাদি পড়িয়েছেন। এর মাঝে তার নাসাঈ, মুসলিম, বায়যাবী, ইবনে কাছীর, বুখারী ছানী ইত্যাদি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

তিনি দীর্ঘদিন মুসলিম, নাসাঈ, বায়যাবি, ইবনে কাছীরের দরস দিয়েছেন। বিগত প্রায় ৭/৮ বছর যাবত তিনি বুখারী ছানীও পড়াচ্ছিলেন। দারুল উলূম দেওবন্দে তিনি সাধারণ শিক্ষক থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন সময়ে সিনিয়র শিক্ষক, মুহাদ্দিস, সিনিয়র মুহাদ্দিস,শায়খুত তাফসীর, শায়খুল হাদীস ছানী, নাযিমে দারুল একামা ,নাযিমে তা'লীমাত, মজলিসে ইলমি'র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ইত্যাদি অনেক সংবেদনশীল কাজে ও মহান দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

বর্তমান দারুল উলূম দেওবন্দের হাতেগোনা কয়েকজন প্রবীণ মুহাদ্দিস ছাড়া প্রায় সকলেই আল্লামা কমরদ্দীনের সরাসরি ছাত্র। এছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের ফুযালায়ে দেওবন্দের সকলেই তার সরাসরি ছাত্র। 


আকাবিরে দেওবন্দের প্রতিচ্ছবি
তিনি ছিলেন আল্লামা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.)-এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। আকাবির ও আসলাফের জীবন-কর্ম এবং নীতি-আদর্শ সম্পর্কে তার জানাশোনা ছিলো অভাবনীয়। তার বয়ানে পূর্বসুরীদের আলোচনা ছিলো অসাধারণ আকর্ষণীয়। উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আল্লামা কামরুদ্দিন সাহেব গৌরাখপুরি- রহ. দরসের কয়েকটি কমন বাক্য ছিল—

* হজরত ওয়ালা থানবি- রেহমতুল্লাহি আলাইহি ফরমাতে থে!

* হজরত মদনি- রেহমতুল্লাহি আলাইহি ফরমায়া করতে থে!

* হজরত কাশমিরি- রাহিমাহুল্লাহ ফরমাথে থে!

* মেরে উস্তাদ আল্লামা ইবরাহিম সাহাব বিলয়াবি- রেহমতুল্লাহি আলাইহি ফরমাতে থে!

হযরত রাহিমাহুল্লাহ তার দারসে আকাবের আসলাফের মালফুজাত, তাদের ঈমান জাগানিয়া ঘটনাবলী খুব বর্ণনা করতেন। এজন্য তার সম্পর্কে মাওলানা শুয়াইব আলিগড়ি ঠিকই  বলেছিলেন,

اسلاف کی یادیں زندہ ہے، جب تک یہ قمر تابندہ ہے!

অর্থাৎ, যতক্ষণ এই চাঁদ ( হুজুরের নামের অর্থ) আলোকিত থাকবে, ততক্ষণ আসলাফ আকাবেরের আলোচনাও যিন্দা থাকবে!

সুলুক ও তাসাউফ 
তিনি আল্লামা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.)-এর নির্দেশে খলীফায়ে থানভী হযরত আলামা শাহ ওয়াছীউল্লাহ খান এলাহাবাদী (রহ.)-এর হাতে বাইয়াত হন। পরবর্তীতে তাকে খেলাফত প্রদান করেছেন হযরত ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.),হযরত শাহ ওয়াছিউল্লাহ খান,শাহ আবরারুল হক হারদুঈ, হযরত কারী সিদ্দীক আহমদ বান্ধবী  এবং খলীফায়ে মাদানী হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান বাটিয়ালভী (রহ.)। 

আল্লামা গৌরখপুরি আল্লামা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.)-এর দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত ছিলেন। তিনি প্রতিদিন দারুল উলূম দেওবন্দের তৈয়ব মসজিদে বদা আসর ইসলাহী মজলিস করতেন। আধ্যাত্মিক দীক্ষা অর্জনের জন্য হযরতের উসতায আল্লামা ইবরাহীম বালিয়াভী (রহ.) তাকে হযরত থানভী (রহ.)-এর খলীফা হযরত আল্লামা ওয়াছীইল্লাহ খান এলাহাবাদী (রহ.)-এর কাছে পঠান এবং চিঠিতে লিখে দেন, ‘ইলমে যাহেরী যা দেওয়ার ছিল আমি দিয়ে দিয়েছি, এখন ইলমে বাতেনী, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতার জন্য আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমি কোনো সুপারিশ কর ছিনা, আপনার যা ভালো মনে হয় করবেন ‘ চিঠি পড়ে হযরত আল্লামা শাহ ওয়াছীউল্লাহ খান এলাহাবাদী (রহ.) মুচকি হেসে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটাও তো এক ধরনের সুপারিশ।’

এরপরে পরম স্নেহে হযরত আল্লামা কামরুদ্দিন আহমদ গৌরখপুরীকে বাইয়াত করে নেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হযরত আল্লামা শাহ ওয়াছীলীউল্লাহ খান এলাহাবাদী (রহ.)-এর এমন প্রিয়পাত্রে পরিণত হন যে, একদিন পরম ভালোবাসায় বলেন, যখনই কেউ বাইয়াত হবে তুমিও তাতে শরিক থাকবে। কখনো কখনো তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিতেন। 

মুহিউস সুন্নাহ হযরত শাহ আবরারিল হক হারদুঈও  আল্লামা কামরুদ্দিনকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করতেন। হারদুঈতে আল্লামা কামরুদ্দিন বয়ান করতেন আর হযরত আবরারুল হক খুব মনোযোগ দিয়ে তা শুনতেন।

হজ ও মক্কায় দরসে হাদীস
জীবনে তিনি বেশ কয়েকবার হজ ও উমরা করেছেন। প্রথমবার হজ করেন ১৯৬৩ সালে। একদিন তিনি মক্কায় হজ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন জনৈক আলেম কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলে তিনি অত্যন্ত প্রমাণ নির্ভর যৌক্তিক উত্তর প্রদান করেন। এসময় উপস্থিত থাকা আমীরে মক্কা জনাব মাওলানা সাঈদ খান সাহেব তার বক্তব্যে এবং জ্ঞান-গরিমায় প্রভাবিত হয়ে হারাম শরীফে প্রতিদিন তাকে দরসে হাদীসের জন্য অনুরোধ করেন। সে মুতাবিক তিনি প্রায় দুইমাস পর্যন্ত হারাম শরীফে প্রতিদিন মাগরিবের পরে বিপুল সংখ্যক মানুষের সামনে দরসে হাদীস প্রদান করতেন।


দাওয়াতী সফর
দাওয়াতী সফরে তিনি হিন্দুস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশের বাইরে ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ,পাকিস্তান, বার্মা, সৌদি প্রভৃতি অঞ্চল সফর করেন।

সহজ-সরল জীবনযাপন
আকাবির ও আসলাফের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ছিলেন তিনি। ছিলেন ইত্তিবায়ে সুন্নতের আশিক। সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। বাজার সাদাই,ওষুধপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজেই কেনাকাটা করতেন। হাজার হাজার ছাত্র শাগরেদ থাকলেও বাসাবাড়ির খেদমতে কাউকে নিযুক্ত করা পছন্দ করতেন না। সুন্নত পরিপন্থী কিছু দৃষ্টি গোচর হলে নরমে-গরমে তার সংশোধন করতেন।

খোলাফায়ে কেরাম
বাংলাদেশে হযরতের লাখো ছাত্র-শিষ্যদের পাশাপাশি খোলাফায়ে কেরামের মাঝে রয়েছেন—

১। হযরত মাওলানা মাহবুবুল হক কাসেমী (শায়খুল হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর ঢাকা)। 

২। হযরত মাওলানা আবদুর রাজ্জাক মানিকগঞ্জী(শায়খে ছানী, জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়া,বসিলা,মোহাম্মদপুর ঢাকা)।

৩। হযরত মাওলানা আবুল কালাম কাসেমী (মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস, দারুল উলূম ঢাকা, মিরপুর-৬)।

৪। হযরত মাওলানা মুফতী নাসিরুদ্দিন কাসেমী কক্সবাজারি (শায়খুল হাদীস,জামালুল কুরআন, গেণ্ডারিয়া, ঢাকা)।

৫। হযরত মাওলানা মুফতী রেজাউল হক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ (মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস, দারুল উলূম ঢাকা,ধামরাই ঢাকা)

৬। মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী (মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর ঢাকা)।

এছাড়াও তিনি যাদেরকে বিশেষ ইজাযতে ধন্য করেছেন তাদের মাঝে হযরত মাওলানা আব্দুল মতীন বিন হুসাইন (মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস,জামিয়া হাকীমুল উম্মত কেরানীগঞ্জ, ঢাকা) অন্যতম শীর্ষ।


লেখালেখি
হযরতের নিয়মতান্ত্রিক লেখালেখির মাশগালা না থাকায় সৃজনশীল কোনো গ্রন্থ না থাকলেও আছে জাওয়সহেরাতে কমর নামে ১টি বয়ান সংকলন এবং আলা-কালামুন নেহায়ী নামক ১টি তাকরীর সংকলন। প্রথমটি গ্রন্থস্থ করেছেন হযরতের ছাত্র ও মুরিদ মাওলানা সা'আদাতুল্লাহ খান আর দ্বিতীয়টি মলাটবদ্ধ করেছেন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ কসেমী।

হযরতের সাথে আমার সম্পর্ক
হযরতের কাছে আমার নাসাঈ এবং মুসলিম আওয়াল পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এছাড়া দেওবন্দের দীর্ঘ ছয় বছরে আমি ছিলাম হযরতের ছফর ও হযরের খাদেম। হিন্দুস্তান ও বাংলাদেশের বহু সফরে হযরতের খেদমতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। হযরত আমাকে ছেলের মতো মহব্বত করতেন। আমার কর্মস্থল ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসা, চাঁদতারা জামে মসজিদ, বায়তুস সালাম জামে মসজিদ (পূর্ব শেওড়াপাড়া), আমার ফরিদপুরের বাসা, আমাদের ফরিদপুরস্থ মহিলা মাদরাসা জামিয়া খাদীজাতুল কুবরা (রা.) মহিলা মাদরাসা, ভাটিলক্ষিপুর,ফরিদপুরে হযরতের শুভাগমনে আমরা ধন্য হয়েছি। এমনকি আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দিরাসাহ আল ইসলামিয়া ঢাকা-এর প্রতিষ্ঠা হযরতের হুকুমে এবং হযরতের মাধ্যমেই হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। ৬ এপ্রিল ২০১৮ রোজ শুক্রবার চাঁদতারা জামে মসজিদে জুমা পড়িয়ে হযরত মারকাযুদ্ দিরাসাহ-এর ইফতিতাহ করেন। হযরতের সাথে ঢাকাতে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ, জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়া বসিলা, বায়তুল আমান মিনার মসজিদ,বায়তুল আমান আদাবর, জামিয়া মুহাম্মাদিয়া মোহাম্মদপুর, বায়তুল ফালাহ মোহাম্মদপুর, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া মোহাম্মদপুর, জামিয়া হুসাইনিয়া আরজাবাদ, জামিয়া দারুল উলূম মসজিদুল আকবার কমপ্লেক্স মিরপুর-১, জামিউল উলূম মিরপুর-১৪, খাদেমুল ইসলাম মিরপুর-১৩, দারুল উলূম মিরপুর-৬, দারুল উলূম মিরপুর-১৩, মুসলিম নগর মাদরাসা মিরপুর, দারুর রশাদ পল্লবী, জামিয়া ইমদাদিয়া কল্যাণপুর, জামিয়া দারুল উলূম মতিঝিল ওয়াপদা, মতিঝিল পীরজঙ্গী মাদরাসা,আমিনবাজার মাদরাসা সাভার, ব্যাংক কলোনী সাভার, শায়েখ যাকারিয়া রিসার্চ সেন্টার খিলক্ষেত, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, বাবুস সালাম উত্তরা, জামিয়া ইমাম বুখারী উত্তরা, জামিয়া কোরআনিয়া চৌধুরীপাড়া, জামিয়া ইকরা হাজীপাড়া, জামিয়া শারইয়্যাহ্ মালিবাগ, জামিয়া আজমিয়া রামপুরা বনশ্রী, জামিয়া সাঈদিয়া কারিমিয়া বারিধারা, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, জামিয়া দারুল উলূম টঙ্গী-২৭, জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী, বায়তুন নূর সায়েদাবাদ,জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ,জামালুল কোরআন গেণ্ডারিয়া,বায়তুল উলূম ঢালকানগর, জামিয়াতু ইবরাহীম সাইনবোর্ড, মাদানীনগর মাদরাসা, সাইনবোর্ড আবদুল বারী সাহেবের মাদরাসা, জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগ, জামিয়া শারিফিয়া লালবাগ,জামিয়া হুসাইনিয়া আশরাফুল উলূম বড় কাটরাসহ অসংখ্য-অগণিত মাদরাসা, মসজিদ, খতমে বোখারী, দরসে বোখারী, বয়ান-নসীহত এবং ইসলাহী প্রোগ্রামে হযরতের জুতাবাহক হিসেবে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার (আলহামদুলিল্লাহ)। 

বাংলাদেশ থেকে আমি ফোন করে সালাম দিলেই চিনতে পারতেন, পরিচয় দেওয়া লাগতো না। ২০১৮ সালে জামিয়া রাহমানিয়া (আবরার) এর মেহমানখানায় বহু খ্যাতিমান ওলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে এই নগন্য গোলামকে এবং মানিকগঞ্জের হুজুরখ্যাত হযরত মাওলানা আবদুর রাজ্জাক মানিকগঞ্জী হাফিযাহুল্লাহকে ইজাযত প্রদান করেন তিনি।

হযরতের সাথে সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয় চলতি বছর জুন মাসের শেষের দিকে দেওবন্দ সফরে। হুজুর বিছনায় শয্যাশায়ী ছিলেন, ক্যাথেটার লাগানো ছিলো। আমার সাথে ছিলেন বড় ভাই হযরত মাওলানা মুফতী রেজাউল হক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ। আমাদেরকে দেখে হযরত অত্যন্ত আনন্দবোধ করেছেন। সব খোঁজ-খবর নিলেন। একপর্যায়ে বললেন-

دو پہر میں میرے ساتھ کھانا کھانا ہے

কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে এর আগে হযরতের বাসার শাহী দস্তরখানের রোটি-বোটি এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলা এই নগন্য খাদেমকে বহুবার তৃপ্ত করেছেন। আসার সময় হযরতের হাত ধরে অনেকসময় পর্যন্ত কেঁদে ছিলাম, হযরতও খুব আবেগাপ্লুত ছিলেন। মনে হচ্ছিল আর দেখা হবে কি না!

দোআ চাইলে হযরত মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং দো'আও করলেন। আমি এখনো আমার মাথায় হযরতের সেই স্নেহ পরশ অনুভব করছি।

ইন্তিকাল
আমার শায়খ ও মুরশিদ হযরত আল্লামা কমরুদ্দিন আহমদ গৌরখপুরি (রহ.) ৮৬ বছর বয়সে গত ২২ ডিসেম্বর-২০২৪ তারিখে ফজরের পূর্ব মুহূর্তে দেওবন্দের নিজ বাসায় মৃত্যৃবরণ করেন। এদিন দুপুর ২টায় জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং কাসেমী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

লেখক : মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

বিএইচ/এটিআর


Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর