মুসলিম মনীষী
সামাজিক ও জাতীয় জীবনে ফুলতলীর পীরের অবদান

চৌধুরী আলী আনহার শাহান
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯:৫১
-6783c8db81a20.jpg)
ছবি : সংগৃহীত
আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.) (১৯১৩-২০০৮) ছিলেন একজন প্রখ্যাত পীর, সুফি ও ইসলামী চিন্তাবিদ। যিনি তার জীবনে ইসলামের খেদমত করেছেন অনন্যভাবে। ১৯১৩ সালে সিলেটের জকিগঞ্জের ফুলতলী গ্রামে জন্ম নেন। তার পিতা মাওলানা আব্দুল মজিদ চৌধুরী (রহ.) ছিলেন ফকিহবীদ। শাহজালাল (রহ.)-এর সফরসঙ্গী শাহ কামাল (রহ.)-এর বংশধর।
বিংশ শতাব্দীতে কোরআনের ভুল তিলাওয়াতের প্রবণতা বাড়ে, কিন্তু অনেক আলেম নীরব ছিলেন। তিনি ‘দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করে বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের প্রচার শুরু করেন। এর ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বে তাজবীদী শিক্ষা এবং ভুল কিরাত চর্চার হ্রাস ঘটে।
ফুলতলীর অন্যতম একজন শিক্ষক ও পীর ছিলেন শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.)। তার নির্দেশে মাক্কার বিখ্যাত ক্বারী ইরকছুছ আল মিশরী (রহ.), হাফিজ আব্দুর রউফ করমপুরী শাহবাজপুরী (রহ.)-এর কাছ থেকে ক্বিরাত শিক্ষা করে সনদ লাভ করেন। তারপর ১৩৫১ সনে তিনি মক্কা শরিফের বিখ্যাত ক্বারীদের উস্তাদ আহমদ হিজাজী মক্কীর কাছ থেকে সহিহ কোরআন শিক্ষার সনদ লাভ করেন। আর এই সিলসিলাহ পৌঁছেছে স্বয়ং রাসুল (সা.) পর্যন্ত।
ফুলতলীর পীর মাতৃভূমিতে ফিরে প্রথমে ভারতের আদম খাকি (রহ.)-এর মাজার সংলগ্ন মসজিদে কোরআনের বিশুদ্ধ শিক্ষা দিতে শুরু করেন। এরপর সিলেটের জকিগঞ্জ বারগাত্তায় সপ্তাহে একদিন পাঠদান করেন এবং ১৯৪০ সালে নিজ বাড়িতে (বর্তমান দারুল ক্বিরাতের প্রধান কেন্দ্র) সহিহ কোরআনের শিক্ষা চালু করেন। ছাত্রসংখ্যা বাড়লে তিনি পিতার নামে ‘দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের ৩৩ একর জমি ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দেন।
তাছাড়া ফুলতলী ছিলেন একজন দরদী অভিভাবক, সফল সমাজ সংস্কারক ও বিশ্বস্ত ভরসাস্থল। তাকে বিভিন্ন উপমায় সিক্ত করা যায়। ভক্তরা তাকে শামছুল উলামা, ছাহেব কিবলাহ (রহ.) নামে অভিসিক্ত করেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে ভালোবাসত। গরীব-দুঃখী বিশেষত এতিমদের নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে ইসলামী আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় এবং সামাজিক জীবনে সাহসী ভূমিকা পালন করে গেছেন।
জীবনের শেষ দিকে এসে ফাযিলকে ‘ডিগ্রী’ ও কামিলকে ‘মার্স্টাস’ এর মান প্রদান এবং স্বতন্ত্র ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সিলেট থেকে হাজারো গাড়ি নিয়ে ঢাকা অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চ কর্মসূচি দেন। সেখানে আমিও অংশ নিয়েছিলাম।
ফুলতলীর এই পীর ইসলামী খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার মাধ্যমে দেশ-বিদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং শত শত মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, লতিফিয়া এতিমখানা, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসা, হজিরত শাহজালাল দারুচ্ছুনাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদ্রাসা, অরাজনৈতিক জনসম্পৃক্ত দল বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ, ছাত্রদের সংগঠন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া এবং মুসলিম হ্যান্ডস।
তার লেখা অনেক উর্দু ও আরবি গ্রন্থ ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রচিত গ্রন্থাবলি পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে পড়ানো হয়।
আল্লামা ফুলতলী ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ভক্তদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরকালীন সফরে চলে যান। তবে তার রেখে যাওয়া উত্তম আদর্শের পথ আজও জীবন্ত। রাব্বে কারিম তাকে জান্নাতের উঁচু মর্যাদায় অভিসিক্ত করুন। আমীন।