-67a745747963d.jpg)
বরিশাল শহরের অদূরে অবস্থিত চরমোনাই। চরমোনাই বহুল পরিচিত শব্দ হওয়ার কারণে অনেকেই চরমোনাইকে কোনো ব্যক্তির নাম ভেবে থাকেন। তবে এটি একটি ইউনিয়নের নাম। এটি বরিশাল সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের নামটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও পরিচিত হয়ে উঠেছে সেখানকার পীর সাহেবের জন্য। চরমোনাই ইউনিয়ন কালের বিবর্তনে হয়ে উঠেছে এক আধ্যাত্মিক রাজধানী।
চরমোনাইর প্রথম পীর ছিলেন মাওলানা সৈয়দ ইসহাক (রহ.)। তিনি এই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই এখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমান দেশের অন্যতম দ্বীনি মার্কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শুরু থেকে সেখানে প্রতি বছর একটি মাহফিল হত। ধীরে ধীরে সেই মাহফিল রূপ নেয় বিশালাকারে। আনুমানিক ১৯২৪ সালে চরমোনাইর মাহফিলের সূচনা হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও এই মাহফিল বন্ধ ছিল না। নানা চড়াই উৎরাই চরমোনাইর মাহফিল পার করেছে একশত বছর। মাওলানা ইসহাক (রহ.) ছিলেন ক্বারি ইব্রাহিম (রহ.)-এর খাস ছাত্র ও খলিফা। আর ক্বারি ইব্রাহিম (রহ.) ছিলেন ভারতের অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহাবার মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.)-এর খলিফা। চরমোনাইর মাহফিল প্রথম দিকে ছিলো এটি মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল হিসেবে। পরবর্তীকালে সেটা সেটা রূপ নেয় একটি আন্তর্জাতিক মুসলিম গণজমায়েত হিসেবে। চরমোনাইতে বছরে দুটি মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার অগ্রহায়ন ও ফাল্গুন মাসে এই দুটি মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই মাহফিলে সারা দেশ থেকে দলমত নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন।
চরমোনাইর মাহফিল প্রথমে ছোট্ট একটি মাঠে অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে ৬টি মাঠ জুড়ে এই মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৬টি মাঠের আয়তন প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার। বিশাল এলাকা জুড়ে এই মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মাহফিল ঘিরে চরমোনাই ইউনিয়নের আশ পাশের ইউনিয়নে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ধারণা করা হয়- চরমোনাইর মাহফিলের ফাল্গুনের মাহফিলে প্রায় ১ কোটির মতো লোক সমাগম হয়। মাহফিলে চরমোনাইর পীর সাহেবের ভক্ত, অনুসারী ছাড়াও সারা দেশ থেকে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মাহফিলে অংশ নেয়।
অগ্রহায়নের চেয়ে ফাল্গুনের মাহফিলে জনসমাগম বেশিই হয়ে থাকে। মাহফিলের মাঠ পেরিয়ে আশেপাশের মানুষের বাড়িঘরের উঠানে, কীর্তনখোলা নদীর ওপর থাকা শত শত দানবাকৃতির লঞ্চে বসেও বয়ান শুনে আগত মুসল্লিরা। কীর্তনখোলা নদীর তীরেই এই মাহফিলের মাঠ। সারা দেশ থেকে লঞ্চ, স্পীডবোট যোগে নৌপথে লাখ লাখ মানুষ মাহফিলে অংশ নেন। এ ছাড়াও পদ্মা সেতু হবার পর সকড় পথেও মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। দুর্গম চরাঞ্চল, তার ওপর নৌপথ- এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি সত্যি বিস্ময়কর।
চরমোনাইর মাহফিলে মোট ৭টি তরিকার বয়ান করা হয়। তার মধ্যে পাঁচটি বয়ান করেন আমিরুল মোজাহেদীন মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাই এবং দুটি বয়ান করেন নায়েবে আমিরুল মেজাহেদীন মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম শায়েখে চরমোনাই।
এ ছাড়াও দেশ-বিদেশের বরেণ্য আলেম ও ইসলামিক স্কলারগণ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে হৃদয়গ্রাহী বয়ান করেন। প্রতিবছর ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের শীর্ষ আলেমগণ উপস্থিত হন। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার শীর্ষ আলেমদের বড় একটি অংশ চরমোনাইর মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও শুরু হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম গণজমায়েত ঐতিহাসিক চরমোনাইর মাহফিল। আগামী ১৯, ২০ ও ২১ জানুয়ারি ফাল্গুনের মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
ধারণা করা হচ্ছে- এ বছর অতীতের সকল রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চরমোনাইর পীর সাহেবের সাথে বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতাদের সাথে ঐক্যের আলাপ চলছে। জামায়াত আমিরও কিছুদিন আগে চরমোনাইর দরবার পরিদর্শন করে এসেছেন। চরমোনাইর এবারের মাহফিলে বিভিন্ন ইসলামি দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিতি হবারও সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও আমন্ত্রণ পেয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
মাহফিলের দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠিত হয় ওলামা মাশায়েখ ও সুধী সম্মেলন। সেখানে অংশ নিয়ে দেশ জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন আমন্ত্রিত শীর্ষ আলেম ওলামা, ইসলামিক স্কলার, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দলের নেতারা। মাহফিলের দ্বিতীয় দিন সকাল ৯টা থেকে এই সম্মেলন শুরু হয়। তবে এবারের ওলামা ও সুধী সম্মেলন অন্যান্য বছরের চেয়ে আলাদা হতে পারে। ইতোমধ্যে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। মাহফিল ঘিরে সারা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ চরমোনাইর মাহফিলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এটা বলার প্রয়োজন নেই যে, এবারের চরমোনাইর মাহফিল অতীতের চেয়ে বহুগুণ বড় হতে যাচ্ছে। আগামী ১৯ জানুয়ারি বুধবার বাদ জোহর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাইর উদ্বোধনী বয়ানের মধ্য দিয়ে মাহফিল শুরু হবে এবং ২২ জানুয়ারি আখেরি মুনাজাতের মধ্যে মাহফিল শেষ হবে। চরমোনাইর দরবার একেবারে আলাদা। এখানে অন্যান্য পীরের দরবারের মতো মাজার নেই। নেই আলোকসজ্জা ও চাকচিক্য। এখানে মানুষ আসে একমাত্র আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য। চরমোনাই পীর সাহেব উদ্বোধনী বয়ানে স্পষ্ট বলে দেন যে, এখানে দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য কেউ যদি এসে থাকেন তাহলে নিয়ত পরিশুদ্ধ করে নিন। আল্লাহ তায়ালা বিশ্বের অন্যতম মুসলিম গণজমায়েত চরমোনাইর মাহফিলকে মানুষের হেদায়েতের উছিলা হিসেবে কবুল করুন। আমীন।
লেখকের মেইল : nurahmadsdk@gmail
- বাংলাদেশের খবরের ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkislamic247@gmail.com
বিএইচ/