প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬:৪৪
-67b464a38cbce.jpg)
সর্বমহলে পরিচিত মুখ নন তিনি। নন কোনো যশস্বী ব্যক্তি। বাকপটুতা কিংবা ওয়াজের ময়দানেও নেই তেমন খ্যাতি। পরিচিতি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহও নেই তাঁর কোনো। ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতের মূর্ত প্রতীক তিনি। নীরবে কাজ করে যেতে পারা তাঁর কাছে তৃপ্তির। নিজ কাজ নিজে করতে পারা তাঁর কাছে গৌরবের। তিনি স্পষ্টভাষী। নিরহংকার। সুলেখক। যুগ সচেতন রাহবার। মানবতার কল্যাণকামী। উম্মাহর দরদি। প্রচারবিমুখ। কর্তব্যপরায়ণ। নিরলস কর্মী। নিষ্ঠাবান আলেম। স্বাপ্নিক। স্বপ্ন দেখেন। দেখান অন্যকেও।
কাজ নীরবে করে গেলেও তাঁর কীর্তি ও অবদান হইচই ফেলে দিয়েছে আলেম সমাজে। জানান দিচ্ছে, কর্মবীরের অস্তিত্বের কথা। জাতির জন্য তাঁর প্রয়োজনের কথা। কর্মের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর স্বদেশ থেকে ভিনদেশে। উম্মাহর কল্যাণে এমন কিছু ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তিনি, যেগুলো সময়ের বিপ্লবী চাহিদা। যুগসচেতনতা ও কর্মযজ্ঞতায় ইতোমধ্যেই তিনি সুপরিচিতি লাভ করেছেন আলেম সমাজে। ওলামায়ে কেরামের কাছে নতুন করে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। তবে নতুন প্রজন্ম তাঁকে জানার এবং তাঁর মিশনকে বোঝার প্রয়োজন আছে। যারা এখন শিক্ষার্থী বা তালিবে ইলম তাদেরকে এই বিরল রত্নের সন্ধান দেওয়ার জন্যই মূলত এই রচনা। বলছিলাম মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান হাফিজাহুল্লাহ-এর কথা।
অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা, কিছু লিখবো এই মনীষীকে নিয়ে। ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবো কিনা, তিনি আবার কিছু মনে করেন কী না, ব্যক্তির জীবদ্দশায় তাঁর কর্ম ও কীর্তি বন্দনা ঠিক হবে কিনা, ইত্যাদি ভেবে নিবৃত্ত থেকেছি। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এ আশঙ্কাও কাজ করছিল মনে।
জীবদ্দশায় গুণীজনের কদর হয় না আমাদের দেশে। যুগ-যুগ ধরে চলে আসা এই মন্দ সংস্কৃতি দেখে আসছি শৈশব থেকে। গভীর উদ্বেগের সাথে। মৃত্যুর পরই শুরু হয় এদেশে গুণীজনের গুণকীর্তন। কদর হয় তাঁর গুণের। মত্ত হয় স্তুতি—বন্দনায়। জানাযায় নামে মানুষের ঢল। জাতির সামনে তুলে ধরা হয় মরহুমের ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা, চিন্তা ও খেদমতগুলো বড় আকারে। এই সংস্কৃতিটা আমার কাছে ভালো ঠেকে না। এর মধ্যে হিংসা ও সমসাময়িকদের অবমূল্যায়নের একটি গন্ধ আছে।
কবি সুন্দর বলেছেন—
أَوْلَعَ النَّاسُ بِامْتِدَاحِ الْقَدِيْمِ + وَبِذَمِّ الْجَدِيْدِ غَيْرِ الذَّمِيْمِ
لَيْسَ إِلَّا لِأَنَّهُمْ حَسَدُوْا الْحَيَّ + وَرَقُّوْا عَلَى الْعِظَامِ الرَّمِيْمِ
‘মৃতের প্রশংসায় উৎসাহী মানুষ + অনিন্দ্য নবীনে খুঁজে মন্দের ঘ্রাণ,
সহিংস তারা সদা জীবিতের প্রতি + জীর্ণ অস্থিতে হয় কোমল তাদের প্রাণ।’
মারকাযুদ্দাওয়া এর আমীনুত তালীম, মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ-এর জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা আরবি কিতাব كلمات عن أخبار الشيخ محمد عبد المالك الكملائي وأهم إنجازاته পড়তে গিয়ে একটি ইবারতে দৃষ্টি আটকে গেল। ইবারতটি হচ্ছে,
إِنَّ مِنَ الْعَيْبِ الشَّنِيْعِ تَرْكَ ذِكْرِ الْفَضَائِلِ وَالْمَآثِرِ لِكُبَرَاءِ أَهْلِ الْعِلْمِ وَالْفِقْهِ قَبْلَ وَفَيَاتِهِمْ،
‘ইলম, ফিকহ ও দ্বীনের বিভিন্ন অঙ্গনে সমকালীন শীর্ষ ব্যক্তিদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অবদান স্বীকার না করা নিকৃষ্টতম দোষ।’
ইবারতটি পড়লাম কয়েকবার। ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো! আমাদের মধ্যে এই অবমূল্যায়নের ব্যাধি বিদ্যমান। এই ইবারত আমার সকল দ্বিধা—সংশয় দূর করে দিল। চিন্তা করলাম, মাওলানা মুহাম্মদ সালমান হাফি. সম্পর্কে যা লিখতে চেয়েছি লিখে ফেলি। এই লেখা কারো কারো অন্তদৃর্ষ্টি খুলেও দিতে পারে। কারো জন্য হতে পারে পরশ পাথরের সন্ধান।
মৃত্যুর পর হা—হুতাশ করার চেয়ে জীবদ্দশায় গুণীজনকে জেনে তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হওয়ার মধ্যেই কল্যাণ! ‘কদরে নেয়ামত বা’দায যাওয়াল’ না হয়ে ‘ক্বাবলায যাওয়াল’ই হওয়া উচিত। দাঁত থাকতেই তো দাঁতের যত্ন নেওয়া দরকার। মৃত্যুর পর বড়ত্ব ও ফযীলত বর্ণনায় ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখানো হলেও, —যদিও মৃত ব্যক্তি না সম্মানের মুহতাজ, না প্রশংসার— সান্নিধ্যে থেকে তাঁর প্রতিভা, দর্শন, ব্যক্তিত্ব ও কর্মকৌশল দেখে সরাসরি উপকৃত হওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। কারণ জীবদ্দশায় তাঁকে পরিচিতই করা হয়নি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাকে ফুটিয়ে তোলা হয়নি। মোটকথা, আমাদের সংস্কৃতিটাই এমন যে, আমরা গুণীজনকে পরিচিত করি তাঁর মৃত্যুর পর। জানা যায় যখন; ততক্ষণে সংশ্রব গ্রহণের আর সুযোগ থাকে না। জীবিত শিষ্যদের কেউ মরহুমের ব্যক্তিত্ব, চিন্তা ও দর্শনকে ধারণ এবং উপযুক্ত প্রচারের ব্যবস্থা করলে সেগুলোর অনুসরণে যদিও অন্যরা উপকৃত হতে পারে। তবে সংশ্রব গ্রহণের ফায়দা থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। হাতেকলমে দীক্ষা গ্রহণে আক্ষেপই হয় একমাত্র প্রাপ্তি।
মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান। বিখ্যাত সাহাবী হযরত সালমান ফারসি রা. এর মতই তাঁর জীবনের টার্ন। তাই তো মা—বাবার রাখা শৈশবের 'মুসা গাজী' নামকে ছাপিয়ে তিনি পরিচিত হয়েছেন মুহাম্মাদ সালমান নামে। ১৯৫০ সালে সাতক্ষীরা জেলাধীন কালীগঞ্জ থানার নলতা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা বাহাদুর গাজী। মাতা ভাগ্য বিবি। স্কুল কলেজের আঙ্গিনায় কাটিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ সময়। মাদরাসায় এসেছেন যথেষ্ট বয়স হওয়ার পর। শিক্ষা জীবনের মাঝপথে এসে শুরু করেন নতুন পথে যাত্রা। দীর্ঘ কোর্স সম্পন্ন করে হয়েছেন আলেম। ধন্য হয়েছেন বিংশ শতাব্দীর জগদ্বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ও দাঈ, মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভীর সংশ্রবে। অর্জন করেছেন তাঁর খেলাফত।
বিরল ও অসংখ্য প্রশংসনীয় গুণাবলির অধিকারী ক্ষণজন্মা এই মনীষী দেওবন্দী চিন্তার একজন আলেম। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। সমাজ চিন্তক। বাংলাদেশে সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক। শিক্ষানুরাগী। দরদি সংস্কারক। আলী মিয়া নদভী রহ. ও মাওলানা শামছুল হক ফরীদপুরী রহ. - এর চিন্তার ধারক—বাহক। প্রচারক ও বাস্তবায়ক। তাঁদের মিশনের একনিষ্ঠ কর্মী। মাদরাসা দারুর রাশাদ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের উপদেষ্টা ও পরামর্শক। ধর্মীয় বই—পুস্তক, পত্র—পত্রিকা ও স্মারক প্রকাশক এবং পৃষ্ঠপোষক।
তিনি কল্যাণের ফেরিওয়ালা। ফেরি করে বেড়ান কল্যাণ মানুষের ঘরে ঘরে, দ্বারে দ্বারে। ক্ষয়ীষ্ণু মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে এবং মুসলিম জাতির মধ্যে নবযৌবন ফিরিয়ে আনতে তাঁর প্রচেষ্টার শেষ নেই। শাসিত ও শোষিত মুসলিম মিল্লাতকে শাসকের আসনে আসীন করার দারুণ এক আকুলতা তাঁর চোখে—মুখে! হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে মুসলিমদের চালকের আসনে বসানোর সীমাহীন ব্যাকুলতা তাঁর ধ্যানে—জ্ঞানে! এক কথায়, উম্মাহর জন্য নববী দরদে টইটুম্বুর মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান এর মন।
তিনি ভাবেন ইসলামকে নিয়ে, সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে। তাঁর এ ফিকরে উম্মাহ শুধু মসজিদ—মাদরাসা কিংবা মাদরাসার ছাত্র ও ওলামায়ে কেরামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত মুসলিম শিক্ষার্থীদের নিয়েও তিনি চিন্তা করেন। ভাবেন তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ত সাধারণ মুসলমানদের কথা। আত্মপরিচয় ভোলা, দ্বীনের চর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষদের নিয়ে ভাবেন তিনি। চিন্তা করেন সমগ্র মানবতার কথা। নতুন প্রজন্মকে দ্বীনের উপর টিকিয়ে রাখার চিন্তায় সদা অস্থির তাঁর মন। বই—পুস্তক, পত্র—পত্রিকা, ইসলাহি কর্মশালা, ওয়াজ—মাহফিল, যুব কনফারেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি নিজের ভাবনা ও অস্থিরতাগুলো তুলে ধরেন। প্রস্তাব পেশ করেন। দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
অমুসলিমদের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রমের পৃষ্ঠপোষণ, নওমুসলিমদের সহযোগিতা ও পুনর্বাসন, খ্রিস্টান মিশনারীদের বিপরীতে এনজিও কার্যক্রম, ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন মোকাবিলায় সাহিত্য ও সাংবাদিকতা চর্চায় গুরুত্বারূপ, প্রতিটি মুসলিম শিশুকে অপরিহার্য দ্বীনি শিক্ষার আওতাধীন করার জন্য মাকতাব শিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহ প্রদান ও গুরুত্বারূপ, যুগসচেতন চৌকস দাঈ তৈরি, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সমন্বিত শিক্ষাকার্যক্রমসহ মুসলিমদের আর্থ—সামাজিক উন্নতি কল্পে বহুমুখী কার্যক্রমের সাথে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান। দেশ ও জাতির যেকোনো দুর্যোগে অস্থির হয় তাঁর মন। দুর্যোগ কবলিত জনপদের বাসিন্দাদের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হন তিনি। তাদের ব্যথায় হন ব্যথিত। সহানুভূতি প্রকাশ করেন। সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়ান। সাহায্যের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বৃদ্ধ বয়সেও দুর্গত এলাকায় ছুটে যান সশরীরে। তাঁর দুআয় সবসময় ওঠে আসে ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, সিরিয়া, কাশ্মীর, চীন, মিশরের নির্যাতিত মুসলমানদের কথা। এমন একজন উদার ও বিশ্বজনীন চিন্তার মানুষ সত্যিই এই উম্মতের জন্য অনেক বড় সম্পদ।
তিনি ব্যতিক্রমী চিন্তার একজন বিরলপ্রজ মানুষ। তাঁর দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। কর্মপরিধি বিস্তৃত। চিন্তার উদারতা তাঁর বিশেষ গুণ। সর্বদা উম্মাহর প্রয়োজন সামনে রেখে চিন্তা করেন। কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উম্মাহর প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনে স্রোতের বিপরীত চলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। দ্বীনি খেদমতের শূন্যতার জায়গাগুলোতে শূন্যতা পূরণের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন জেনারেল শিক্ষা থেকে দ্বীনি শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠা বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের আদলে স্বল্পমেয়াদী আলেম কোর্সের প্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসা দারুর রাশাদ’।
নিজে ভুক্তভোগী হওয়ায় বয়স্কদের জন্য দ্বীনি শিক্ষার সহজ উপায় বের করার ফিকির ছিল তাঁর মাথায় ছাত্র যমানা থেকেই। সেই ফিকিরেরই সার্থক ফসল ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসা দারুর রাশাদ’। উম্মাহর কল্যাণে চলমান হাজারো প্রচেষ্টার মধ্যে এটি একটি বেতিক্রমী প্রয়াস। হাল যমানার মানুষের মনস্তত্ত্বকে সামনে রেখে প্রণীত এর কর্মপরিল্পনা। উম্মাহর চিন্তা—চেতনা পুনর্গঠন ও বিকাশ ঘটানো এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ‘ফিকরে উম্মাহ’ তথা উম্মতের সামগ্রিক কল্যাণ ভাবনা এর প্রাণ। এসএসসি, এইচএসসি ও অনার্স—মাস্টার্স করা হাজার হাজার জেনারেল শিক্ষিত মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। উম্মাহ পাচ্ছে দরদি ও চৌকস একদল কর্মঠ আলেম ও দাঈ।
গড়ে তুলেছেন ‘রাশাদ একাডেমি’ নামে সমন্বিত শিক্ষার এক বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে দ্বীনি ইলম ও জাগতিক শিক্ষা উভয় ধারায় পারদর্শী একদল আলেম অবতীর্ণ হচ্ছে কর্মের ময়দানে। যাদের বেশিরভাগই হাফেজে কুরআন বা বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের অধিকারী আলেম। জেনারেলে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্নকারী। বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষায় স্ট্যান্ডসহ অত্যন্ত সন্তোষজনক ফলাফল নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উভয় ধারায় শিক্ষা সমাপনকারী। যোগ্যতা—দক্ষতায়ও পিছিয়ে নেই তারা অন্যান্য মাদরাসা বা স্কুলের শিক্ষার্থীদের থেকে। দরসে নেজামী, মাদানী, বৈষয়িক, দ্বীনি সকল ধারা একীভূত হয় এদের মধ্যে। একদিকে ‘ওয়াবিহি ক্বালা হাদ্দাসানা’ এর পাঠে তারা হয় ঋদ্ধ। অপরদিকে কলেজ—ইউনিভার্সিটির সকল স্তর অতিক্রম করে আধুনিক জ্ঞান—বিজ্ঞানে হয় সমৃদ্ধ। ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানা ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা’ এই পবিত্র বাণী তাদের অনুপ্রেরণা। এটি অর্জনে ধন্য হওয়া তাদের সাধনা।
কর্মব্যস্তদের মৌলিক দ্বীনি শিক্ষার সুবিধার্থে চালু করেছেন নৈশ বিভাগ। মসজিদ ভিত্তিক বয়স্কদের কুরআন ও মাসায়েল শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। লেখালেখির ময়দানে ইসলামপন্থিদের শক্ত অবস্থান তৈরির জন্য চালু করেছেন ‘সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী এডুকেশন সেন্টার’ সংক্ষেপে (সাহানেক) নামে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার তাখাসসুস কোর্স।
মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান একজন বইপ্রেমী মানুষ। একটি বই লেখা থেকে শুরু করে প্রকাশ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের সাথে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ও প্রীতির। উত্তেজনা ও আবেগের। ঔরসজাত সন্তানের জন্ম তাঁর কাছে যেমন আনন্দের, কাগুজে সন্তানের জন্মেও তিনি তেমনই আনন্দিত হন। বই লেখা, বই পড়া, অন্যকে পড়ে শোনানো, প্রকাশ করা, বই সংগ্রহ ও বইয়ের প্রচারে তাঁর উচ্ছ্বাস ও স্বতঃস্ফূর্ততা অনুসরণযোগ্য। তাঁর কাছে গেলে বা মজলিসে বসলে সন্ধান পাওয়া যাবে নতুন কোনো বইয়ের। সুযোগ হবে অদেখা কোনো বই দেখার। টেবিলে থাকা বইটি সম্পর্কে তিনি পর্যালোচনা করবেন সযতনে। ফজিলত বর্ণনা করবেন মুগ্ধমনে। পড়তে দিবেন উদার মনে। একাধিক কপি থাকলে হাদিয়া দিতেও ভুলবেন না। ছাত্রদের বই কেনার প্রতি উৎসাহ প্রদানকালে কোনো মজলিসে তাঁর বই উঁচিয়ে ধরার দৃশ্যটি শিরোপা জয়ী ব্যক্তির উচ্ছ্বাসের মতই আবেগপূর্ণ। বইয়ের প্রচার এমনভাবে করেন, যেন প্রচার মাইক তিনি। পত্র-পত্রিকা, বই—পুস্তক আর লিফলেট আদান-প্রদানের মাধ্যমে আলো বিতরণের এই মহৎ গুণ যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
মানুষের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো, আকাবিরের ফিকির ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার, ধর্মীয় চেতনা জাগ্রতকরণ এবং সমকালীন ফেতনা সম্পর্কে সতর্কীকরণের লক্ষ্যে দুই মাস অন্তর নিয়মিত প্রকাশ করেন ‘আর—রাশাদ’ পত্রিকা। শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা—কর্মচারী, পরিচিত ও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আত্মশুদ্ধি, তাদের মধ্যে জিম্মাদারির অনুভূতি ও খোদাভীতি জাগ্রত করণের উদ্দেশ্যে সাপ্তাহিক ইসলাহি মজলিস, মাসিক ইসলাহি ইজতেমা, তালিম ও তরবিয়তি মজলিসের নিয়মিত আয়োজন ও পরিচালনা করে থাকেন।
এছাড়াও যেসব গুণ তাকে সমকালীনদের মধ্যে অনন্য করেছে, সেগুলো হলো—
১। আপাদমস্তক একজন ত্যাগী মানুষ তিনি। ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের এই যামানায় বিলাসিতাপূর্ণ জীবন বেছে নেননি। জীবন যাপন পদ্ধতি তাঁর একেবারে সাদামাটা। চলাফেরায় অতি সাধারণ।
২। দরদে উম্মাহ তাঁর চরিত্রের সবচে’ আলোকিত দিক। উম্মতের সামগ্রিক কল্যাণ চিন্তা তাঁর ব্যক্তিত্বকে করেছে সর্বজনীন।
৩। চিরতরুণ একজন মানুষ। বার্ধক্য যাকে কাবু করতে পারেনি। সত্তরোর্ধ বয়সেও তিনি তারুণ্যদীপ্ত। টগবগে যুবকের মত উদ্যমী ও কর্মঠ। তিনি সেই বৃদ্ধ যার বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মত প্রদীপ্ত যৌবন।
৪। তাঁর ব্যক্তিত্বকে কাছের মানুষ বুঝতে পারেনি। দূরের মানুষ চিনতে পারেনি। দূরের মানুষ চিনতে না পারার কারণ তো হলো, তার প্রচারবিমুখতা ও অকৃত্রিমতা। আর কাছের মানুষ বুঝতে না পারার কারণ, ব্যক্তি হিসেবে তিনি অস্বাভাবিক কর্মক্ষমতাসম্পন্ন। তিনি এত বেশি কর্মঠ এত বেশি উদ্যমী, মনোবল তাঁর এত দৃঢ়, যেকোনো কাজে এত বেশি শক্তি আর হিম্মত পান যে, অন্য অনেকের মধ্যে এই পরিমাণের হিম্মত, কর্মশক্তি এবং মনোবল বিদ্যমান নেই। তিনি চান তাঁর মতই উদ্যমী ও কর্মতৎপর হোক সবাই। এ চাওয়াটাই হয়ে পড়ে অনেকের জন্য ভারি।
৫। তিনি সবসময় খাদেম হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। মাখদুম হওয়াটা তাঁর কাছে অপছন্দনীয়।
৬। তিনি ক্ষমাশীল উদার মনের অধিকারী। ভুলে যেতে পারেন বড় আঘাতও। মনে রাখেন না, ধরে রাখেন না কোনোকিছু। প্রতিশোধ পরায়ণ নন। যদিও প্রতিশোধ গ্রহণের শক্তি ও সুযোগ থাকে।
৭। অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, কষ্টসহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বড় বড় বিপদও তাঁর মনোবলকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।
৮। সময়ানুবর্তী। খুবই সময় সচেতন। রুটিন ও পরিকল্পনা মাফিক কাজ করার ব্যাপারে অতি সংবেদনশীল।
৯। কাজের মানুষ। নিজে কাজ করতে জানেন। অন্যের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতেও জানেন।
১০। তাঁর কর্মপন্থা হচ্ছে, ‘নরম নরম গুফতেগো, গরম গরম জুশতে জো।’ অর্থাৎ ‘কথা হবে নরম নরম, কাজ হবে গরম গরম।’
১১। কাউকে উৎসাহ প্রদান, সহযোগিতা বা সমর্থনের মাধ্যমে এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে এগিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন না বিন্দুমাত্রও। এব্যাপারে তাঁর মনে কোনো প্রতিহিংসা কাজ করে না।
১২। তিনি ঐসকল বিরলপ্রজ মানুষের অন্তভুর্ক্ত, যারা ইহসানের বদলায় শুধু ইহসান নয়; মুকাফাআত করেও তুষ্ট হতে পারেন না। সামান্য প্রাপ্তির বিপরীতে অনেক বেশি কৃতজ্ঞতা আদায়ের মত অতিকৃতজ্ঞ মানুষ তিনি।
একটি কথা আছে, ٍلِكُلِّ عَالِمٍ زَلَّةٌ تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ غَيْرُ كَامِل কোনো মানুষই ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। দোষে—গুণেই মানুষ। এটাই মানুষের সৌন্দর্য। কেউই শতভাগ নিখুঁত নয়। সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি মুক্ত থাকা কেবল আল্লাহরই শান। মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলা এই মর্যাদা বরাদ্দ রাখেননি। মানুষ তো কেবল নিজের মধ্যে ভালো গুণের সমাহার ঘটাতে পারে। সকল মন্দ থেকে চাইলেও সে বাঁচতে পারে না। এখানেই মানুষের সীমাবদ্ধতা।
যে মানুষের দোষের চেয়ে গুণের পরিমাণ বেশি, তিনিই ভালো মানুষ। আর যার গুণের পাশে দোষ নিতান্তই সামান্য, তিনি তো মহামানব। মাওলানা মুহাম্মদ সালমান সাহেব কোনো ফেরেশতা নন। তবে অতিমানব ও মহামানবসুলভ অনেক গুণই তার চরিত্রে উজ্জ্বলভাবে বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা এই মহান মানুষটির ছায়া আমাদের জন্য দীর্ঘায়িত করুন। আমীন।
- বাংলাদেশের খবরের ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkislamic247@gmail.com
লেখকের মেইল : abusaidkishorgang@gmail.com
বিএইচ/