আদিল মাহমুদ
কবিতা প্রেমের বাইরেও আছে— মায়ের অপেক্ষা, যুদ্ধের আর্তনাদ
প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫১

ছবি : বাংলাদেশের খবর
কবি যখন নিজের অন্তর্গত অনুভূতিগুলোকে ছন্দ ও গদ্যের ছাঁচে গেঁথে একাধিক স্তবকে প্রকাশ করেন, তখন তাই হয়ে ওঠে কবিতা। কবিতা কেবল শব্দের খেলা নয়, এটি মানুষের মনের কথা বলে— বলে সমাজ পরিবর্তনের কথা।
যুগে যুগে যখনই সমাজে বিশৃঙ্খলার ছায়া নেমে এসেছে, তখনই কবিতা আবির্ভূত হয়েছে সভ্যতার এক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে। কবিতা ভেঙে দিয়েছে অন্যায় ও অনিয়মের সিংহাসন, জাগিয়েছে মানুষকে, গড়েছে বিবেক। এজন্য কবিতার প্রতি মানুষের বিশ্বাস, টান ও শ্রদ্ধা সব সময়ই বিশেষ। অনেকেই কবিতাকে পবিত্রতার স্তম্ভ হিসেবে দেখেন—একটি নৈতিক উচ্চতার প্রতীক হিসেবে মানেন।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে অধিকাংশ কবিতা কেবল নারী ও প্রেমকেন্দ্রিক বিষয়েই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে নবীন কবিদের অনেকেই কবিতার ছন্দ গড়ছেন নারীর শরীর, প্রাক্তনের স্মৃতি কিংবা আবেগময় ভালোবাসার গল্প ঘিরে। ফলে পাঠক ও শুদ্ধসাহিত্যের অনুরাগীরা ক্রমেই হতাশ হচ্ছেন। কবিতার যে ঐতিহ্য, যে দায়িত্ব—তা যেনো কিছুটা ধুয়েমুছে যাচ্ছে এসব একমাত্রিক আবেগে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে কথা বলেছেন সময়ের আলোচিত ও খ্যাতিমান কবি আদিল মাহমুদ। তিনি কবিতায় শুদ্ধতার গুরুত্ব, কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং তার নিজের কাব্যচর্চা নিয়ে তুলে ধরেছেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু তালহা রায়হান—
বাংলাদেশের খবর : আসসালামু আলাইকুম। কবি, কেমন আছেন আপনি?
আদিল মাহমুদ : ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আল্লাহর রহমতে শান্তিতে আছি। আপনি কেমন আছেন? আশা করি ভালো ও সুস্থ আছেন। আপনাদের সাথে কথা বলতে পেরে খুব ভালো লাগছে।
বাংলাদেশের খবর : বর্তমানে তরুণ কবিদের বেশিভাগ কবিতা প্রেম এবং নারীর শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি কী মনে করেন, কবিতার মূল উদ্দেশ্য কি শুধুমাত্র এই বিষয়গুলো নিয়ে হওয়া উচিত?
আদিল মাহমুদ : কবিতা যদি শুধু প্রেম আর শরীরের মধ্যে আটকে থাকে, তাহলে সেটাকে আমি বড়ো বাগানের ছোট্ট কোণায় বন্দি একটা ফুলগাছ বলব। কবিতার আসল শক্তি হলো অনুভব, উপলব্ধি আর প্রতিবাদ—যা মানুষের আত্মা ছুঁয়ে যায়। প্রেম তো জীবনের একটা অংশ, কিন্তু জীবন তো শুধুই প্রেম নয়। এখানে আছে ক্ষুধা, যুদ্ধ, বঞ্চনা, মাতৃত্ব, মৃত্যুভয়, আত্মসংঘাত, নিঃসঙ্গতা, আত্মদর্শন—সবকিছুই কবিতার উপাদান।
আমার চোখে কবিতা কেবল রোমান্টিকতার ভাষ্য নয়, এটা সময়ের মুখ। কবিতা যেনো হতে পারে একজন নীরব মানুষের আর্তনাদ, একজন নির্যাতিতের প্রতিবাদ, অথবা একজন নিঃসঙ্গের কান্নার অনুবাদ। আমি চাই, তরুণ কবিরা শুধু প্রেমের শরীর নয়, সময়ের দগদগে ক্ষতগুলোকেও ছুঁয়ে দেখুক।
কবিতা এমন এক আয়না, যেখানে শুধু নিজের মুখ নয়—সময়ের মুখ, সমাজের মুখ, এমনকি ইতিহাসের মুখও ফুটে উঠতে পারে। কবিতা যদি শুধু প্রেম নিয়ে কথা বলে, তাহলে সেটা হৃদয়কে স্পর্শ করবে। কিন্তু কবিতা যদি সাহস করে সত্যি বলতে পারে, তাহলে সেটা মন, সমাজ আর সময়—সবকিছুকেই বদলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের খবর : কবিতায় শুদ্ধতা আসা উচিত—এর সঙ্গে আপনি কি একমত? আপনার মতে শুদ্ধতার মানে কী? এটি কবিতায় কীভাবে ফুটে ওঠে?
আদিল মাহমুদ : আমি একমত, কবিতায় শুদ্ধতা থাকা দরকার—কিন্তু এই শুদ্ধতা কোনো গোঁড়ামি নয়, এটা আত্মার সৌজন্যবোধ। শুদ্ধতা মানে কবিতাকে পবিত্র বানানো নয়, বরং কবিতাকে এমন জায়গায় দাঁড় করানো, যেখানে ভাষা পাঠকের মনকে কলুষিত না করে উদ্ভাসিত করে।
আমার কাছে শুদ্ধতার মানে হলো, কবিতা এমন হোক যা মানুষকে জাগায়। কবিতায় কামনা থাকতে পারে, কিন্তু তা যেনো হয় অন্তর থেকে, অনুভব থেকে। শুধু সস্তা প্রদর্শনী নয়, প্ররোচনা নয়।
কবিতা যখন অশ্লীলতার ছায়ায় ঢেকে যায়, তখন ভাষা আর ভাব দুটোই কেবল দেহের প্রদর্শনীতে আটকে পড়ে। কিন্তু শুদ্ধ কবিতা সে জায়গা ছাড়িয়ে যায়; সে স্পর্শ করে হৃদয়, বিবেক আর সময়।
শুদ্ধতা ফুটে ওঠে তখনই, যখন কবি নিজে বুঝেন—শব্দের একটা ওজন আছে, একটা দায়িত্ব আছে। কবি যখন নিজের কলমকে খেলনার মতো নয়, দায়িত্বের মতো ব্যবহার করেন, তখনই কবিতা শুদ্ধ হয়। আমি চাই কবিতা শুধু দেহ না, হোক আগুনের শিখা।
বাংলাদেশের খবর : কবিতায় প্রেমিকা বা প্রাক্তনের প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য ধরনের বিষয় নিয়ে আরও কবিতা রচনা করা যেতে পারে?
আদিল মাহমুদ : আমার বিশ্বাস, কবিতার আসল শক্তি তখনই প্রকাশ পায়, যখন তা প্রেমিকা বা প্রাক্তনের বৃত্ত পেরিয়ে বৃহত্তর জীবনের দিকে যায়। প্রেম একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুভব, তবে সেটিই কবিতার একমাত্র ভাষা হতে পারে না।
আমরা প্রতিদিন যে সমাজে বেঁচে থাকি, সেখানে আছে যুদ্ধ, অন্যায়, নিঃশব্দ কান্না, বিশ্বাস আর আত্মত্যাগ—এসব কিছুই কবিতার বিষয় হতে পারে। একজন গরিব রিকশাচালকের ভোরবেলা, একজন মা’র চুপচাপ অপেক্ষা, একজন ছাত্রের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন—এসব দৃশ্যও গভীর প্রেমের চেয়ে কোনো অংশে কম আবেগময় নয়।
আমি মনে করি, কবিতাকে একা কোনো স্মৃতির গন্ধে আটকে রাখা নয়, বরং সময়ের সাথে হাঁটতে শেখানো উচিত। জীবন নিজেই এক অনন্ত কাব্য, সেখানে প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি বাস্তবতা, প্রতিটি নীরবতা—একেকটা কবিতার খোরাক। প্রেমের বাইরে যে জগৎটা আছে, সেটাই তো আসলে সবচেয়ে বেশি চেনা, সবচেয়ে বেশি সত্য। আর সত্যই তো কবিতার শেষ আশ্রয়।
বাংলাদেশের খবর : আপনি যখন কবিতা লেখেন, তখন কি সমাজের কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা বা সামাজিক পরিবর্তনকে তুলে ধরতে চান? যদি হ্যাঁ, তাহলে কীভাবে?
আদিল মাহমুদ : হ্যাঁ, আমি যখন কবিতা লিখি, তখন শুধু নিজের অনুভূতি নয়, আমার পরিবার, আমার বিশ্বাস, আমার সমাজ—সব মিলেই কবিতা লেখার চেষ্টা করি। আমি এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা, মানুষের প্রতি মমতা, সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিদিনের শিক্ষা ছিল। আমার ধর্ম আমাকে শিখিয়েছে, শব্দও একটা আমানত, যার জবাবদিহি আছে।
তাই কবিতা আমার কাছে কেবল সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, এটি এক ধরনের দায়িত্ব। আমি চেষ্টা করি এমন বিষয়গুলো তুলে ধরতে, যেগুলো হয়তো আমাদের চারপাশে প্রতিদিন ঘটে—কিন্তু আমরা দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না। সমাজের ভাঙা আয়নাগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই, কখনো সরাসরি নয়, কবিতার ভেতর দিয়ে—নরমভাবে, কিন্তু গভীরভাবে।
আমার পরিবার আমাকে শিখিয়েছে, শব্দ দিয়ে আঘাত নয়, জাগরণ ঘটাতে হয়। আর ধর্ম আমাকে শিখিয়েছে, কলম কখনো অশ্লীলতায় নত হয় না, বরং সত্যের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
আমি চাই, আমার কবিতা যেন এমন কিছু বলুক, যা মানুষ শুধু পড়ে না, অনুভবও করে। যেন একজন পাঠক হঠাৎ থেমে গিয়ে ভাবে, ‘এই কথাটা তো আমাকেই বলা, ‘ অথবা যেন একজন মা চোখের জল মুছে বলেন, ‘এই কথাটা তো আমার হয়েই কেউ বলেছে।’
আমার কাছে কবিতা মানে শুধু ছন্দ কিংবা গদ্য নয়। একটা নীরব প্রতিবাদ, একটা বিশ্বাসের কণ্ঠস্বর। আর সেই কণ্ঠস্বরের ভেতরেই আমি আমার পরিবার, আমার ঈমান আর আমার দায়বদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রাখি।
বাংলাদেশের খবর : আপনার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের কবিতায় কোন ধরনের বিষয় বস্তু বেশি প্রাধান্য পেয়েছে?
আদিল মাহমুদ : আমার কাব্যগ্রন্থগুলো যেনো আমার দৈনন্দিন জীবন, সমাজ, সংগ্রাম আর স্মৃতির এক অ্যালবাম। সেখানে আমার দেখা, শোনা এবং অনুভব করা প্রতিটি মুহূর্ত কোনো না কোনোভাবে রূপ পেয়েছে কবিতায়।
ধর্ম, দেশের ঐতিহ্য, পরিবার, প্রেম—এই সবকিছু আমার কবিতার মেরুদণ্ড। আমি বিশ্বাস করি, একজন কবির কলম তার বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও আত্মার আয়না। তাই আমার কবিতাগুলোতে যেমন রয়েছে একজন সন্তানের চোখে মায়ের অবিরাম ত্যাগ, তেমনি রয়েছে একজন বিশ্বাসী মানুষের অন্তরের আলো ও দ্বিধা।
জীবনবোধ, সুখ-দুঃখ, শোককাতর মুহূর্ত—এসব অনুভব আমি লেখার মাধ্যমে ছুঁতে চেয়েছি। চেষ্টা করেছি পাঠকের হৃদয়ে এমন কিছু রেখে যেতে, যা শুধুই পড়ে ফেলার জন্য নয়, অনুভব করার জন্য।
আমার কবিতা আনন্দ দেয় না সবসময়, বরং অনেক সময় প্রশ্ন তোলে, ভাবায়, কখনো কাঁদায়ও। আমি চেয়েছি, যেনো আমার কবিতার প্রতিটি পৃষ্ঠা হয়ে ওঠে আমার সময়, আমার সমাজ আর আমার আত্মার নিঃশব্দ সাক্ষ্য।
বাংলাদেশের খবর : সমাজ ও জাতির কল্যাণে কবিতা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে? আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী?
আদিল মাহমুদ : আমি বিশ্বাস করি, কবিতা যদি সত্যিকার অর্থে হৃদয় থেকে আসে, তবে সেটি সমাজ ও জাতির চেতনাকে বদলে দিতে পারে। কবিতা হলো শব্দের মধ্যে গাঁথা এক ধরনের নীরব বিপ্লব—যেটা কখনো চিৎকার করে না, কিন্তু মানুষের ভেতরের জমাট বাঁধা ভাবনাগুলোকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলে।
আমার কাছে কবিতা কেবল রোমান্টিক কল্পনার জায়গা নয়; এটি প্রতিবাদের ভাষা, আত্মসচেতনতার আয়না এবং কখনো কখনো জাতির গভীর সংকটের দিকে আঙুল তোলা এক নির্মল হাত।
একটি কবিতা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়—নিজেকে, সমাজকে, সময়কে। এটি ভেতর থেকে মানুষকে নৈতিকভাবে জাগিয়ে তুলে, যেটা রাজনৈতিক ভাষণ বা শক্তিশালী আইন দিয়েও সবসময় সম্ভব হয় না।
আমি বিশ্বাস করি, কবিতা যদি বিশ্বাস, ন্যায়, বিবেক আর মানবতার পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে সেটি জাতির মনন গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। কবিতা তখন কেবল সাহিত্য নয়, তখন তা হয়ে ওঠে জাতির আত্মার স্পন্দন।
বাংলাদেশের খবর : আমাদেরকে সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে সুস্থ রাখুক। ভালো থাকুন সবসময়।
আদিল মাহমুদ : আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ এমন একটি প্ল্যাটফর্মে নিজের কিছু কথা বলার সুযোগ পাবার জন্য। আপনার প্রশ্ন আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে, নিজেকেও জানতে সাহায্য করেছে। আল্লাহ আপনাকেও ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন এবং সত্য ও সৌন্দর্যের পথে কাজ করার তাওফিক দিন।
- এটিআর