Logo
Logo

অর্থনীতি

টাকা ছাপানোর প্রভাব কতটা পড়বে মূল্যস্ফীতিতে

Icon

আতাউর রহমান সোহাগ

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:০৩

টাকা ছাপানোর প্রভাব কতটা পড়বে মূল্যস্ফীতিতে

মূল্যস্ফীতির ‘পাগলা ঘোড়া’ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি, বাজার তদারকি, টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রিসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। উল্টো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ থাকলেও বাধ্য হয়েই টানতে হচ্ছে মূল্যস্ফীতির বোঝা।

এ অবস্থার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ৬ ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোক্তারা। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যা আগের তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ ও আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ।

তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের সময়ও টাকা ছাপিয়ে একের পর এক ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বেশি মূল্যে কিনতে হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। উচ্চবিত্তরা জীবন নির্বাহ করতে পারলেও হিমশিম খাচ্ছেন মধ্য ও নিম্নবিত্তরা।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকা ছাপালেই তার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়ে না। মূল্যস্ফীতির বেড়ে যাওয়ার আরও অনেক কারণ আছে। এটা নিয়ে সাধারণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিও আছে। 

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারত আশ্রয় নেওয়ার পর দেশের অর্থনীতিসহ সকল খাতেই ‘দুর্বৃত্তায়ন’ ও ‘লুটপাটের’ তথ্য সামনে আসতে থাকে। আর সবচেয়ে বেশি লুটপাটের শিকার হয়েছে ব্যাংক খাত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান শেখ হাসিনার আমলে বছরে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। শুধু এস আলমের বিরুদ্ধেই এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পেয়েছে সিআইডি। এতে চরম বিপাকে পড়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। সবল ব্যাংকগুলো টাকা ধার দিলেও সংকট কাটেনি। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ৬ ব্যাংককে দিয়েছে।

টাকা ছাপানোর কারণে মূল্যস্ফীতিতে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএমের) সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, শুধু টাকার সরবরাহ বাড়লেই মূল্যস্ফীতি বাড়ে না। মূল্যস্ফীতির বেড়ে যাওয়ার আরও অনেক কারণ আছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ নিত্যপণ্যের বাজারের সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। এতে পণ্যের দাম বাড়ে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু টাকা ছাপাবে সেহেতু সরবরাহ বাড়বে। যেকোনো লোকই এখন ধারণা করতে পারে এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে। তাত্ত্বিকভাবে এই ধারণা ঠিক আছে, কিন্তু ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমরা স্ট্যাবিলাইজেশন সম্পর্কে জানি। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন টাকা ছাড়বে, আবার অন্যদিকে তারা বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে টাকা তুলে নেবে।

ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, গভর্নর নিজেই বলেছেন, এক হাতে টাকা দেবেন, অন্য হাতে আবার তুলে নেবেন। এভাবেই তারা ভারসাম্য ঠিক রাখবে। সুতরাং এটি হচ্ছে স্ট্যারিলাইজিং পলিসি। এই নীতির কারণে নতুন টাকা ছাপালেও মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব কম পড়বে।

তবে সাধারণ মানুষরা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গোলাম রসুল নামের একজন একজন ভোক্তা বলেন, পূর্বে দেখেছি বাংলাদেশ ব্যাংক যখনই টাকা ছাপিয়েছে বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা হয়তো অনেক বুঝে কথা বলেন। কিন্তু আমরা বাজারে গেলে এর বাস্তবতা বুঝতে পারি।

এ বিষয়ে ড. তৌফিক আহমদের ব্যাখ্যা একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, যে দুই ধরনের মূল্যস্ফীতি কথা আমরা জানি তার মধ্যে একটি হচ্ছে চাহিদাজনিত (ডিমান্ড পুল), আরেকটি হচ্ছে উৎপাদন খরচজনিত (কস্টপুল)। কিন্তু আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির ধরন হচ্ছে কাঠামোগত। আমাদের পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটি মূল্যস্ফীতির কারণ। এজন্য বাংলাদেশের মতো দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে গেলে শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েই কাজ হবে না। নিত্যপণ্যের বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থাও ঠিক করতে হবে।

আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত অক্টোবরে নতুন পলিসি রেট (নীতি সুদহার) দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করে। একই কারণে নতুন করে টাকা না ছাপানোর কথা বলেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তবে তিনি এই সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেননি। 

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই দুর্বল ৬টি ব্যাংককে ধার দিয়েছে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এও বলেছেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক অবস্থান পরিবর্তন করবে না।

গভর্নর বলেন, নতুন করে টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়া হলেও বন্ডের মাধ্যমে সবল ব্যাংকগুলোর থেকে টাকা তুলে নেওয়া হবে। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন ব্যাংক বিশ্লেষক মাজেদুল হক। তিনি বলেন, সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়া হলেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। কারণ আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভে চার লাখ কোটি টাকা থাকার কথা। এখন বর্তমানে আছে ৩ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা।

তার মতে, যে পরিমাণ টাকা অর্থনীতিতে থাকা প্রয়োজন তার তুলনায় এখনো কম আছে। ফলে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপালেও অর্থপ্রবাহে ঘাটতি থাকবে। সুতরাং টাকা ছাপানোর কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না।

এআরএস/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর