১ম পর্ব
নিঝুম দ্বীপে কমেছে বনায়ন, বেড়েছে বসতি
দ্বীপ আজাদ, নোয়াখালী
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৩৫
নোয়াখালীর প্রধান পর্যটন কেন্দ্র নিঝুম দ্বীপে উদ্বেগজনক হারে কমেছে বনায়ন। গত আড়াই দশকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বনায়ন কমেছে। বেড়েছে বসতি ও কৃষিজমি। এতে হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। বনভূমি কমে যাওয়া পর্যটকরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন।
বন উজাড়ের নেপথ্যে রয়েছেন জনপ্রতিনিধিসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় ডজন নেতাকর্মী। জড়িত রয়েছেন বন বিভাগের এক বোটম্যানও। শতাধিক মামলা থাকলেও আটকানো যায়নি তাদের। তবে দ্বীপ রক্ষায় স্থানীয়দের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসক।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিঝুম দ্বীপে হরিণ বাজার থেকে একটু পশ্চিমে মাটির পথ ধরে মদিনা গ্রাম। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নালা পাড়ি দিতে হয়। চোখ যতদূর যায় শত শত একর ফসলি জমি ও মাঝে মাঝে নতুন বসতিও চোখে পড়ে। কিছুটা পথ গেলেই চোখে পড়ে ফসলি জমিতে আধামৃত কেওড়া গাছ। আরেকটু এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে গহিন বনের। এখানে দেখা মিলবে কেটে ফেলে রাখা হাজার হাজার গাছের গোড়ার অংশ। এভাবেই কয়েক একর বনের গাছ কেটে সাবাড় করেছে চিহ্নিত কয়েকজন। বনখেকোদের ক্রমাগত নিধনের ফলে উদ্বেগজনক হারে কমেছে বনায়ন। এখন গহিন বনেও দেখা মেলে না হরিণের। এতে হতাশ হচ্ছেন পর্যটকরাও।
আরও জানা গেছে, নিঝুমদ্বীপে মূলত ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে বনায়ন শুরু হয়, যা এখনো চলমান। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও মূল নিঝুম দ্বীপে অন্তত ১২ হাজার একর বনায়ন ছিল। যা বর্তমানে ঠেকেছে সাড়ে ৬ হাজার একরে।
অভিযোগ রয়েছে, নব্বইয়ের দশকে প্রভাবশালী মালেক নেতার হাতেই বন উজাড়ের সূত্রপাত। কখনো আড়ালে থেকে আবার কখনো রীতিমতো উৎসব করে কাটা হয়েছে বনের গাছ। তবে এর তীব্রতা বেড়েছে জাতীয় উদ্যান নিঝুম দ্বীপকে যখন ২০০৮ সালে ইউনিয়ন ঘোষণা করা হয়। আর ২০১১-২০২১ পর্যন্ত নির্বিচারে বন কেটেছে টানা দুইবারের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বন কেটেছে রতন মাস্টার, কেফায়েত মেম্বার, খবির মেম্বার, মিজান মেম্বার, সেলিম ও পিস্তল ফারুকসহ অন্তত দেড় ডজন আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি। বন নিধনে জড়িত আছেন বন বিভাগের বোটম্যান আশরাফও। বন কেটে ভূমিহীনদের কাছে বিক্রির রেকর্ডও রয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, হাতিয়ার এমপি ছিলেন মাহমুদ আলী। তখন মালেক নেতারা তার দল করতেন। খবির মেম্বার, রতন মাস্টাররা তার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বন উজাড় করেছেন। বন বিভাগ মামলাও করেছে শতাধিক। কিন্তু সুফল মেলেনি। বনের গাছ কেটে বাড়ি নির্মাণ করেছেন তারা। নিঝুম দ্বীপে প্রচুর হরিণ ছিল। বাগান না থাকার কারণে হরিণগুলো অন্যত্র চলে গেছে। ফলে পর্যটকরা ঘুরতে এসে হরিণ দেখতে পান না। এতে আগ্রহ হারাচ্ছেন পর্যটকরা। মালেক, মেহেরাজ উদ্দিন, মোজাক্কের রতন, কেফায়েত, খবির মেম্বারসহ তাদের সহযোগীরা বন দখলের সাথে জড়িত।
নিঝুপ দ্বীপে ঘুরতে আসা পর্যটক ইমরান হোসেন বলেন, নিঝুম দ্বীপে আগেও এসেছি। এখানে বন ছিল, সি-বিচ ছিল, হাজার হাজার হরিণ ছিল। কিন্তু এখন আর আগের মতো হরিণ চোখে পড়ে না।
সরকার পতনের পর অভিযুক্তদের বেশিরভাগই এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে। চেষ্টা করেও তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ বলেন, ‘নিঝুম দ্বীপকে বাঁচানোর জন্য জনগণকে সচেতনতার কার্যক্রম অব্যাহত আছে। পাশাপাশি দ্বীপের চারপাশে চর এলাকায় বনায়ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে । তাছাড়া যাদের জীবিকা বনের ওপর নির্ভরশীল তাদের সংখ্যা কমাতে বিকল্প পেশা বেছে নিতে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি দরকার সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। যেসব জায়গা দখল হয়ে গেছে সেসব জায়গা উচ্ছেদের তালিকা করা হয়েছে। জরিপ হলে এসব কাজ করা সম্ভব।’
এ বিষয়ে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘আমরা জেনেছি নিঝুম দ্বীপে বন জরিপের অনুমোদন এসেছে। শিগগির জরিপের কাজ শুরু হবে। এছাড়া বন বিভাগ ও জরিপ বিভাগের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে সেটা দ্রুত সমাধান করব। পর্যটকদের জন্য কী ধরনের উন্নয়ন করা যায় তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।’
দ্বীপ আজাদ/এমআই/ওএফ/এমএইচএস/এনআর/