সামাল দিতে হয়রান পুলিশ
শাহবাগে ১৫১ দিনে ৫৪৫ আন্দোলন
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:৫৩
-67b49eeeb5ca3.jpg)
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দেশজুড়ে দাবি হাসিলের মোক্ষম জায়গা হয়ে উঠেছে রাজপথ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা যেন এখন দাবি আদায়ের শহর৷ একটি আন্দোলন শেষ তো আরেকটির শুরু। অটোরিকশা থেকে অটোপাস, আনসার থেকে পুলিশ, বিসিএস থেকে বিডিআর কিংবা সাত কলেজ থেকে তিতুমীর, যারা যেভাবে পারছে দাবি আদায়ে বসে পড়ছে রাজপথে।
দিনে-রাতে দাবি আদায়ের মিছিলে রাজপথ যেন ক্লান্ত এখন। ক্লান্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও। আর নগরবাসীর সীমাহীন ভোগান্তিও যেন আন্দোলনকারীদের কাছে রয়ে গেছে উপেক্ষিতই। পরিস্থিতি এতোটাই বেগতিক রূপধারণ করেছে যে, নির্দিষ্ট গন্তব্যের গাড়ি রাস্তায় চলছে কিনা ৯৯৯-এ ফোন করে সে তথ্য জেনে নিতে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানাতে হচ্ছে খোদ ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি)।
দাবি আদায়ের আন্দোলনে হটস্পট ডিএমপির রমনা বিভাগ। এর মধ্যে শাহবাগ থানা এলাকার মধ্যেই হচ্ছে বেশিরভাগ আন্দোলন। শাহবাগ, প্রেসক্লাব, সচিবালয়, শিক্ষা ভবন মোড়, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এগুলোই এখন আন্দোলনের হটস্পট- বলছেন ডিএমপির রমনা বিভাগের পুলিশের কর্মকর্তারা।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গত ১৫১ দিনে ৫৪৫টি আন্দোলন সামাল দিতে হয়েছে। আমাদের প্রতিটি সদস্যই ক্লান্ত। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়ছেন৷ আমি নিজেও অসুস্থ। তাও দায়িত্বে অবহেলার সুযোগ নেই। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলতে হচ্ছে, বুঝাতে হচ্ছে। এভাবে আর কত দিন সামাল দিতে হবে- জানা নেই।
পুলিশের একাধিক সদস্যও বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সকালে ডিউটিতে আসি রাত ছাড়া ফেরার সুযোগ পাচ্ছি না। এতো চাপ আগে কখনোই পাইনি। কিছু করারও নেই। স্যারেরা যেখানে দুপুরের খাবারের সময় পান না সেখানে এ কষ্টটুকু আমরা মেনে নিয়েছি। তবে তাদেরও প্রশ্ন- এভাবে আর কত দিন?
সাধারণ মানুষ বলছেন, দাবি আদায়ের নামে যারা যখন পারছে যেখানে সেখানে সড়ক-মহাসড়কে বন্ধ করে দিচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকার শঙ্কা নিয়েই এখন বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে। পথে ঘাটে সরকারি-বেসরকারি অফিসের সামনে প্রতিনিয়তই আন্দোলন চলছে। কেউ কারও কথা শুনছেন না। সবাই নিজ নিজ দাবি আদায় ছাড়া ঘরে ফিরতে চান না। কিন্তু কেউ কি নগরবাসীর ভোগান্তির কথা চিন্তা করছে। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার কথা বলছেন তারা।
শুধু রাজধানী নয় দেশের বিভাগীয় জেলা, উপজেলাতেও চলছে আন্দোলন, কর্মসূচি ও অবরোধ। দাবি হোক যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক সেটা আদায় করতেই হবে। এতে ভেঙে পড়েছে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। মানুষকে জিম্মি করে পথঘাট বন্ধ করা হলেও তাতে থোরাই কেয়ার আন্দোলনকারীদের।
সাধারণ জনগণ বলছেন, মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করে পথেঘাটে অবরোধ দিয়ে যার যে দাবি আছে সেগুলো আদায় করছেন৷ যারা এতোদিন বঞ্চিত ছিলেন তাদের জন্য সাধারণ মানুষের একটা সমর্থন রয়েছে। কিন্তু তাদের দাবিটি সঠিক কিনা সেটি আগে বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথাও চিন্তা করতে হবে। দাবি আদায়ের এক পর্যায়ে যদি জনগণের ভোগান্তি চরমে চলে যায় তাহলে এর ফলও ভালো আসবে না।
সম্প্রতি সাত কলেজের সমস্যার সমাধান শেষে নগরবাসী যখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে ঠিক তখনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদার নিয়ে ফের সরব হন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। আমরণ অনশনও পালন করেন তারা। বন্ধ করে দেয় রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও রেলপথ। এরপরই শ্যামলী এলাকায় অবরোধ করে মিরপুর সড়ক বন্ধ করে দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতরা। কিছুদিন পরপরই ভালো চিকিৎসা, স্থায়ী পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে সড়কে বসে পড়ছেন তারা।
একই ধারাবাহিকতায় তারা ফের রোববার শাহবাগ মোড় অবরোধ করে সীমাহীন ভোগান্তির সৃষ্টি করে।
যা বলছে পুলিশ
রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম, শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর, ওসি অপারেশন দেলোয়ার হোসেন ও পেট্রোল ইন্সপেক্টর বুলবুল সর্দারের সাথে কথা হয় বাংলাদেশের খবরের। তারা প্রত্যেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিগত ১৫১ দিন ধরেই দাবি আদায়ের আন্দোলন সরাসরি উপস্থিত থেকে সামাল দিয়ে আসছেন। এর মধ্যে ডিসি মাসুদ আলম আন্দোলনকারীদের আঘাতে আহতও হয়েছেন। একাধিকবার অসুস্থ কিংবা আহত হয়েছেন প্রায় সবাই।
বাংলাদেশের খবরকে তারা বলছেন, যৌক্তিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করছি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের পৌঁছে দিতে। সরকারের সংশ্লিষ্ট যারা কাজগুলো করবেন তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা। উপরের মহলের নির্দেশনা রয়েছে, ‘যারা দাবি দাওয়া নিয়ে আসবে, শান্তিপূর্ণভাবে থাকবে তাদেরকে আমাদের কাছে পৌঁছে দেবেন। আমরা সমাধানের চেষ্টা করব।’ আমরা সেই কাজগুলোই করছি। সেক্ষেত্রে যখন তারা কোনো বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করে, আইনের বাইরে কিছু করার চেষ্টা করে বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ কোথায় আন্দোলন করলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা অচল হয় সেটা যখন তারা বুঝে না তখন তাদের বুঝানোর চেষ্টা করি। যখনই তারা আইনের বাইরে চলে যায় তখনই পুলিশ তাদের সর্বনিম্ন শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
আন্দোলনরতদের সবাই বলেন তাদের দাবি যৌক্তিক, এক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখেন বা কী নির্দেশনা রয়েছে- জানতে চাইলে তারা বলেন, যারা দাবি দাওয়া নিয়ে আসেন যেগুলো যদি সত্যিই যৌক্তিক হয় সেক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করি। আর অযৌক্তিক হলে বুঝাই। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফলই হয়েছি। আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব দেখিয়ে আসছি।
সুপারিশপ্রাপ্ত সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে তারা বলেন, গত সপ্তাহ থেকে তারা আন্দোলন করছে। কিন্তু তাদের বিষয়ে আদালতের একটা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা আদালতেই মোকাবিলা করতে হয়। তারা যখন রাজপথে আসেন তখন তাদের বুঝানোর চেষ্টা করি যে কোড অব কন্ডাক্টের কারণে আপনাদেরকে সহযোগিতা করা সম্ভব হচ্ছে না। আপনারা আইনের মধ্যে থেকে আদালতের মাধ্যমে নিয়ে আসেন। কোথাও যদি মনে হয় রাষ্ট্র কিংবা প্রশাসনের কোথাও অন্যায় হচ্ছে সে জায়গাটায় আমরা আপনাদের সহযোগিতা করব।
সর্বনিম্ন মাত্রা ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের সরানো হয়, সর্বনিম্ন এই মাত্রার মানদণ্ড কী- এমন প্রশ্নে তারা বলেন, পুলিশের প্রথম কাজ হচ্ছে তাদেরকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা। সরে যাওয়ার জন্য বলা। কারণ যখন বড় ধরনের সমাগম হয় তখন এর ভেতরে কালপ্রিট ঢুকে যেতে পারে। তারা যদি রাষ্ট্রীয় স্থাপনা কিংবা কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোনো সম্পদের ক্ষতির চেষ্টা করে সেই দায়ভার আন্দোলনকারীরা নেবে না। তাই আমরা প্রতিনিধির মাধ্যমে তাদের সাথে কথা বলতে চাই। যখন তারা সেটা না করে তখন আমরা তাদের মৌখিক সতর্ক করি। তখনও যদি না যায় আমরা সর্বনিম্ন শক্তি জলকামানের মাধ্যমে তাদেরকে সরানোর চেষ্টা করি।
তারা আরও বলছেন, আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের জানাতে চাই, আন্দোলন করলেও রাষ্ট্রীয় আইন ১৪৪ ধারা যেন ভঙ্গ না হয়। দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন মেনেই করা উচিত। সেক্ষেত্রে তারা সবসময় আমাদের সহযোগিতা পাবেন।
- এনএমএম/এমএইচএস/ওএফ