Logo

আন্তর্জাতিক

বিশ্বের দীর্ঘতম রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি

৪৫ বছর ছিলেন ইসরায়েলি জেলে, নাম উঠল গিনেস বুকে

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:১৩

৪৫ বছর ছিলেন ইসরায়েলি জেলে, নাম উঠল গিনেস বুকে

ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ফিলিস্তিনি বন্দিদের ‘অভিভাবক’ খ্যাত নাঈল বারঘোতি /ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বের দীর্ঘতম সময় ধরে কারাবন্দি রাজনৈতিক বন্দি ও ফিলিস্তিনি বন্দিদের ‘অভিভাবক’ খ্যাত নাঈল বারঘোতি ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। জীবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সময় বন্দিত্বের মধ্যে কাটানোর পর বৃহস্পতিবার তিনি মুক্তি পান।

৬৭ বছর বয়সী বারঘোতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি জীবনের ৪৫ বছর ইসরায়েলের কারাগারে কাটিয়েছেন, যার মধ্যে ৩৪ বছর টানা বন্দি ছিলেন। ২০০৯ সালের গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে, তিনি বিশ্বের দীর্ঘতম সময় কারারুদ্ধ থাকা রাজনৈতিক বন্দি।

ফিলিস্তিনিদের কাছে তিনি ‘আবু আল-নূর’ নামে পরিচিত। ইসরায়েলি কারাগারে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে আটক থাকা ফিলিস্তিনি হিসেবে স্বীকৃত।  

বন্দিত্ব, মুক্তি ও পুনরায় গ্রেপ্তার
২০১১ সালে গিলাদ শালিত বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে তিনি মুক্তি পান। পরে নিজ শহর অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লার নিকটে কোবার গ্রামে ফিরে যান। তবে ২০১৪ সালে ইসরায়েল চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে এবং তার আগের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পুনর্বহাল করে।  

এবার মুক্তির শর্ত হিসেবে বারঘোতি ফিলিস্তিনের বাইরে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে রাজি হয়েছেন। যাতে তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার এড়াতে পারেন।  

সংগ্রামের সূচনা
১৯৫৭ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি ফিলিস্তিনের কোবার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রাম দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ ও ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ ছিল। তার বাবা ব্রিটিশ সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং তার চাচা ১৯৩৬ সালের গ্রেট আরব বিদ্রোহের সময় নিহত হন।  

১৯৬৭ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি ইসরায়েল তার গ্রাম দখল করে। এটাই ছিল আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম দখলদারিত্বের সূচনা।  

তার বোন হানান বারঘোতির মতে, সেই দিন থেকেই ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধের পথচলা শুরু হয়। শৈশব থেকেই তিনি ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করতেন এবং দেওয়ালে দখলবিরোধী স্লোগান লিখতেন।  

১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তিনি তার ভাই ওমর ও চাচাতো ভাই ফাখরির সঙ্গে ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অভিযানে অংশ নেন।  

১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি প্রথমবার গ্রেপ্তার হন এবং তিন মাস কারাগারে কাটান। মুক্তির কয়েক মাস পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন। এবার তাকে টাকা ৩৪ বছর কারাগারে কাটান। তার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এক কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।  

বন্দিদের অভিভাবক
কারাগারে বারঘোতি পড়াশোনার প্রতি গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ইতিহাসের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তিনি বন্দি অবস্থায় হিব্রু ও ইংরেজি ভাষা শেখেন। অন্যান্য বন্দিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ও দীর্ঘতম বন্দিত্বের কারণে তাকে ‘বন্দিদের অভিভাবক’ উপাধি দেওয়া হয়।  

একবার, তিনি লেবুর বীজ চুপিসারে তার মায়ের কাছে পাঠান এবং অনুরোধ করেন যেন তা বাড়ির উঠোনে রোপণ করা হয়। যাতে তিনি তার ভূমির সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখতে পারেন। প্রতি সাক্ষাতে, তিনি তার মাকে এক বোতল পানি দিতেন গাছটিতে দেওয়ার জন্য। একসময় গাছটি ফল দিতে শুরু করলে, তার মা সেই গাছের লেবুগুলো গোপনে তাকে পাঠাতেন।  

প্রেম ও সংগ্রাম
কারাগারে থাকার সময় তিনি ইমান নাফিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ফিলিস্তিনি নারী নাফিকে ১৯৮৭ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাকে ১৯৯৭ সালে মুক্তি দেওয়া হয়।  

তিনি ফাতাহ আন্দোলনের সদস্য ছিলেন। তবে ১৯৯০-এর দশকে যখন ফাতাহ-নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ ত্যাগ করে। তখন বারঘোতি তার সমর্থন পরিবর্তন করে হামাসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কারাগারে থাকাকালীন সময়ে, বারঘোতি তার বাবা-মাকে হারান। তার বাবা-মাকে শেষবারের মতোও দেখতে দেওয়া হয়নি।

কারাগারের বিরুদ্ধে বিজয়
২০১১ সালে গিলাদ শালিত বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পান। মুক্তির পর তিনি আল-কুদস ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস অধ্যয়ন করেন এবং এক মাস পর ইমান নাফির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

নাফি বলেন, আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই এই ফিলিস্তিনি বীরকে বিয়ে করতে রাজি হই।

বারঘোতি তখন বলেছিলেন, এই বিয়ে কারাগারের বিরুদ্ধে আরেকটি বিজয়। যারা আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে তাদের প্রতি এক চ্যালেঞ্জ। এটা বিশ্বাস ও আশার বিজয়।

মুক্তির পর তিনি ও নাফি তাদের জমিতে কাজ করতেন। তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল ইসরায়েল। ফলে বাড়িতেই তিনি গাছপালার পরিচর্যা করতেন।

ফের ইসরায়েলি কারাগারে
২০১৪ সালের ১৮ জুন ইসরায়েলি বাহিনী তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে। এ সময় ২০১১ সালের বন্দি বিনিময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত আরও কয়েকজন ফিলিস্তিনিকেও আটক করা হয়।  

প্রাথমিকভাবে তাকে ৩০ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু শাস্তি শেষ হওয়ার পরও তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দ্রুত তার আগের আজীবন কারাদণ্ড পুনর্বহাল করে। একটি গোপন ফাইলের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে দাবি করা হয়।  

তার আইনজীবী একাধিকবার আপিল ও আবেদন করেন। তবে সবকিছুই বাতিল করা হয়।  

বন্দিত্বের শেষ অধ্যায়
২০২৩ সালের শেষের দিকে ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স সোসাইটির এক রিপোর্টে জানা যায়, কারাগারে বারঘোতির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। তাকে ওফের কারাগার থেকে গিলবোয়া কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাকে চরম নির্যাতন ও মারধরের শিকার হতে হয়।  

এই মাসের শুরুতে নাফি জানান, বারঘোতি তাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে তিনি মুক্তি পেতে চলেছেন। তবে শর্ত ছিল, তাকে ফিলিস্তিনের বাইরে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হবে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, তিনি মুক্তির পর বৃহস্পতিবার মিশরে পৌঁছান।

নাফি জানান, ইসরায়েলি বাহিনী তাকে অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে মিশরে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি।  

তিনি বলেন, তারা বলেছে যে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কারণে আমার ভ্রমণ নিষিদ্ধ। এর অর্থ কী, আমি জানি না। কিন্তু আমার মতো আরও অনেক পরিবারকে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা চাই, তারা যেন আমাদের দ্রুত যাওয়ার অনুমতি দেয়।

সূত্র : মিডলইস্ট আই

  • ওএফ
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর