বাবরি মসজিদের বদলে নতুন মসজিদ নির্মাণ কত দূর?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:৪৯
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে উগ্র হিন্দুরা | ছবি : সংগৃহীত
অযোধ্যা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ধন্নীপুর গ্রাম। গত কয়েক বছর ধরে এই গ্রাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কারণ সরকার এখানে মুসলমানদের জন্য একটা মসজিদ গড়ার জন্য জমি দিয়েছে।
আজকের দিনেই ১৯৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেই জমিতে রামমন্দির নির্মাণ আর তার বদলে অন্য একটি জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি রামমন্দিরের জন্য নির্ধারন করে নেওয়ার পরিবর্তে ধন্নীপুর গ্রামে মুসলমানদের জন্য পাঁচ একর জমি দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ২০১৯ সালের সেই রায়ের পরই খুব দ্রুত গতিতে যখন রামমন্দির গড়ে উঠেছে, তার উদ্বোধন ও নিয়মিত পূজাও চলছে, অন্যদিকে ধন্নীপুরে মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণ এখনও শুরুই হয়নি।
কোথায় ধন্নীপুর?
উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর-অযোধ্যা-লক্ষ্ণৌ মহাসড়কে রৌনাহি থানার পাশ থেকেই শুরু হয় ধন্নীপুর গ্রাম। যে জমিটা মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়া হয়েছে, সেটা মহাসড়ক থেকে ২০০ মিটার দূরে।
সেখানে পৌঁছে দেখা গেল যে, জমিতে টেন্ট ভাড়া দেন যারা, সেরকম কয়েকজন অনুষ্ঠান-বাড়ির শামিয়ানা শুকোতে দিয়েছেন। কৃষকরা তাদের গবাদি পশু চরাচ্ছেন আর মাঠের মাঝখানে একটা দরগাহ নজরে এল।
জমি হাতে পাওয়ার প্রায় চার বছর পরও কোথাও কোনো নির্মাণ কাজ চোখে পড়ল না। শুধু কয়েকটি জায়গায় সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে।
অন্যদিকে অযোধ্যার রাম মন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ পরে যে নির্মাণ কাজ বাকি ছিল, তাও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাম মন্দির নির্মাণে প্রায় ১৮০০ কোটি ভারতীয় টাকা খরচ হচ্ছে। মন্দিরে পৌঁছনোর জন্য রাম-পথ গড়া হয়ে গেছে, সরকারের তরফ থেকে অযোধ্যাকে সাজিয়ে তোলার কাজও চলছে– তার জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।
অত্যাধুনিক নতুন বিমানবন্দর, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন গড়া হয়েছে। অযোধ্যার উন্নয়নের জন্য এবছর কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০ কোটি ভারতীয় টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে আর আলাদাভাবে বিমানবন্দরের জন্য ১৫০ কোটি ভারতীয় টাকা দেওয়া হয়েছে।
দুই ধর্মের দুই উপাসনা-স্থলের ফারাকটা খুব চোখে পড়ছে।
মসজিদ নির্মাণের জন্য যে ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে, তার সচিব আতাহার হুসেন বলছিলেন, ‘দুটোর মধ্যে তুলনা চলে না। রাম মন্দিরের জন্য নির্মাণ কাজ, পাথর খোদাই ইত্যাদি তো দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। এছাড়াও রাম মন্দির গড়ে তুলতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল।’
এত দূরে কে নামাজ পড়তে আসবে!
ধন্নীপুর গ্রামের মানুষজন মসজিদের ব্যাপারে মুখ খুলতে চাইলেন না। তবে মোহাম্মদ ইসলাম নামে একজন বলছিলেন, ‘মসজিদের জন্য অনেকবার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। কিন্তু কাজ তো কিছু্ শুরু হয়নি।’
‘আগে কমিটির সদস্যরা আসতেন ১৫ আগস্ট আর ২৬ জানুয়ারি জাতীয় পতাকা তুলতে, তবে এবছর তারা কেউ আসেননি। আমরা গ্রামের লোকেরাই পতাকা তুলেছি,’ জানালেন মোহাম্মদ ইসলাম।
অল ইন্ডিয়া মিল্লি কাউন্সিলের মহাসচিব খালেক আহমদ খান বলছিলেন, ‘জমিটা দেওয়া হয়েছিল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে। তাদের দায়িত্ব ছিল নির্মাণ কাজ শুরু করা। যদি বাবরি মসজিদ মামলার মুসলমান পক্ষকে অথবা স্থানীয় মানুষকে দেওয়া হতো, তাহলে এতদিনে মসজিদ তৈরি হয়ে যেত।’
‘মসজিদ গড়ার কথা ছিল যারা বাবরি মসজিদে নামাজ পড়তেন, তাদের জন্য। এতদূরে কে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে আসবে!’ বলছিলেন খালেক আহমদ খান।
বাবরি মসজিদ মামলার অন্যতম পক্ষ ইকবাল আনসারি এবছরের শুরুর দিকে মসজিদের কাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, ‘ওয়াকফ বোর্ড জমিটা নিয়ে নিল। তবে কাজ শুরু করার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি তারা। যতদিন মসজিদ অযোধ্যায় ছিল ততদিন আমরা দেখাশোনা করতাম।’
কী কী থাকবে ধন্নীপুরে?
সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড সরকারের কাছ থেকে ধন্নীপুরের জমিটা হাতে পাওয়ার পর তারা ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশেন নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করে।
ওই ট্রাস্ট বলছে, ধন্নীপুরে মসজিদ ছাড়াও অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল এবং ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিতে একটি মিউজিয়াম বানানো হবে।
ওই সংগ্রহশালার নাম দেওয়া হবে ফৈজাবাদের বাসিন্দা এবং ১৮৫৭-র লড়াইয়ের শহীদ আহমেদ উল্লাহ শাহের নামে।
মসজিদের নকশা দুবার বানানো হয়েছে। প্রথমবার দিল্লির অধ্যাপক এসএম আখতার বানিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য কাউকে দিয়ে নকশা বানানো হয়েছে।
অধ্যাপক আখতার বিবিসিকে বলেছেন যে, কেন তার বানানো নকশা খারিজ করা হয়েছে সেটা কমিটির লোকেরাই বলতে পারবে।
ফাউন্ডেশনের সভাপতি জাফর ফারুকি বিবিসিকে বলেছেন, মসজিদ নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি ভারতীয় টাকা দরকার। এছাড়া অন্যান্য পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করতে প্রায় ৪০০ কোটি ভারতীয় টাকার দরকার হতে পারে।
অর্থের অভাবে নির্মাণ শুরু হয়নি
ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের সভাপতি জঈফর ফারুকি বলছিলেন, অর্থের অভাবে এখনও নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। অর্থ যোগাড় করার জন্য একটা কমিটিও হয়েছিল কিন্তু এবছর সেপ্টেম্বর মাসে সেটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
ওই কমিটি সঠিকভাবে কাজ করছিল না বলে জানিয়েছে ফাউন্ডেশন। তবে ওই কমিটিরই এক সদস্য হাজি আরাফাত শেখের ওপরে এখন অর্থ যোগাড়ের দায়িত্ব পড়েছে।
আরাফাত শেখ মুম্বাইতে থাকেন। তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
অর্থ যোগাড়ের চেষ্টা যেভাবে চলছে
যে হাসপাতালটি গড়া হবে, সেটা পরিচালনার জন্য দাতব্য হাসপাতাল চালায় এমন কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ট্রাস্ট। কয়েকটি সংস্থা এগিয়েও এসেছে।
ফারুকির কথায়, ‘বিদেশ থেকে অনেকে অর্থ দান করতে ইচ্ছুক। সেই দান নেওয়ার জন্য যে বিদেশি দানগ্রহণ আইনের অধীনে রেজিস্ট্রেশন করার আবেদন করা হয়েছে। ওই রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে অর্থের অভাব হবে না।’
তিনি এও জানিয়েছেন যে চাঁদা সংগ্রহের জন্য প্রতিটি রাজ্যে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হচ্ছে আর ক্রাউড-ফান্ডিংয়ের ব্যাপারেও ভাবনা-চিন্তা চলছে।
বিজেপির উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি কুয়াঁর বাসিত আলি বলছেন যে, ইতোমধ্যেই কমিটির হাতে এক কোটি টাকা আছে।
অযোধ্যায় টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক আর্শাদ আফজল খান বলছিলেন, ‘ট্রাস্টের উচিত ছিল কাজ শুরু করে দেওয়া। তারপর তারা মানুষের কাছে চাঁদা দেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারত।’ তবে মানুষের উৎসাহে যে কিছুটা ভাঁটা পড়েছে, সেটাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সূত্র : বিবিসি