Logo
Logo

আন্তর্জাতিক

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোন পক্ষকে সমর্থন করা উচিত?

Icon

ইব্রাহিম কারাতাস

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৮

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোন পক্ষকে সমর্থন করা উচিত?

দুনিয়াজুড়ে চলছে যুদ্ধের তাণ্ডব। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, নাকি হয়নি- এই প্রশ্নে ভাগে বিভক্ত বিশেষজ্ঞরা। এক পক্ষের মতে, ইতোমধ্যেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়ার প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। আরেক পক্ষের মতে, বিশ্ববাসী এখনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেশ দূরে অবস্থান করছে।

কোনো বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে যে ধরনের সংকটগুলো দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে সেগুলো প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর প্ররোচনার মাধ্যমে এই সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। যেখানে বৈশ্বিক সম্পর্কগুলো ঐতিহাসিক ক্ষোভ ও অবিশ্বাস থেকে বের হতে পারেনি।

আমি নিশ্চিত নই কতজন আমার সাথে একমত হবেন। তবে আমার যুক্তি হলো একটি ছোট আকারের বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যাকে প্রধানত প্রক্সি যুদ্ধ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। যুদ্ধটি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। তবে গভীরভাবে তাকালে যে কেউ দেখতে পাবে, পুরো পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পেছনে রয়েছে। আরও ইউক্রেনও পশ্চিমাদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে লড়াই করছে।

সোজা কথায়, যুদ্ধটা রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে হলেও এর পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর সক্রিয় সমর্থন ও হস্তক্ষেপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে।

রাশিয়া যে আক্রমণকারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই, প্রকৃতপক্ষে তারাই দোষী। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। গত দুই বছরে আমেরিকা ও ইউরোপ যা করেছে সেটা একপাশে রাখুন। সম্প্রতি পশ্চিমা তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য ইউক্রেনকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। যা দ্বারা বুঝা যায় যে তারা যুদ্ধটা শেষ করতে চায় না।

আর রাশিয়াকে যুদ্ধের মধ্যে টেনে আনার জন্য পশ্চিমারা বিভিন্ন ধরনের প্ররোচনা দিয়েছে। যার মধ্যে অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অন্যতম। পশ্চিমা দেশগুলোর এই পদক্ষেপ ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে বরং যুদ্ধের পরিসর আরও বাড়িয়ে দেওয়া পক্ষে- এমন সন্দেহও প্রকট হচ্ছে।

সম্প্রতি ইউক্রেনকে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে, তারা যুদ্ধ শেষ করতে চায় না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, প্রায় সব নেতাই নিশ্চিত করেছেন যে তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে পিছু হটিয়ে ইউক্রেনকে যুদ্ধ জিততে সাহায্য করবে না। এর মানে এই নয় যে, ইউক্রেন তার দখলকৃত ভূমি রক্ষা করতে সংগ্রাম করবে না। পশ্চিমাদের এই আগুনে ঘি ঢালা, যুদ্ধ আরো বাড়িয়ে দেবে।

অন্যদিকে, পশ্চিমারা এটা বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়নি যে তাদের কর্মকাণ্ড শুধু ইউক্রেনকে রক্ষা করা। কিংবা এই যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।

তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তারা জানে, পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালালে উত্তেজনা আরও বাড়বে। রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে বাধ্য হবে বা ইউক্রেনে আক্রমণ জোরদার করবে। উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি লড়াই করছে বলে দাবি করা কোনো অজুহাত হতে পারে না। কারণ ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থন, রাশিয়ার প্রতি উত্তর কোরিয়ার চেয়ে কয়েক ডজন গুণ বেশি।

এছাড়াও, পশ্চিমারা যখন অবৈধভাবে ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, তখন ঠিক একই ধরনের অবস্থার মধ্যে থাকা গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতি সমর্থনও অব্যাহত রেখেছে।

সমগ্র গাজাজুড়ে ভয়াবহ হামলার মাধ্যমে অবৈধ দখলদারিত্ব ও যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী ইসরায়েলের ওপর পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের সহায়ক হলেও, তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একইভাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এর ফলে, আন্তর্জাতিক মহলে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

ইসরায়েল কি আক্রমণকারী নয়? এটি কি সমস্ত নৈতিক, আইনি নিয়ম ও বিধি ভঙ্গ করছে না? যা পশ্চিমা শক্তিগুলোকে প্রতিষ্ঠা করেছে? যদি লক্ষ্য থাকে অবৈধ দখল শেষ করা, তবে কেন তারা রাশিয়াকে থামাতে চায়, কিন্তু ইসরায়েলকে নয়? ইসরায়েল তাদের বন্ধু এটাই কি কারণ?

প্রশ্ন উঠছে, যদি সত্যিই একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের অবস্থান কী হতে পারে? কোন পক্ষকে অন্যান্য দেশগুলো সমর্থন করতে পারে?

পশ্চিমা ব্লক বা ট্রান্স-আটলান্টিক অঞ্চল যার মধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান একত্রিত হয়ে যুদ্ধের পক্ষে থাকবে। আর রাশিয়া ও চীন যুদ্ধের জন্য জোটবদ্ধ হবে। কিছু দেশ তাদের পাশেও দাঁড়াবে যেমন- লাতিন আমেরিকার দেশগুলো সম্ভবত রাশিয়া-চীন ব্লকের প্রতি নীরব সমর্থন জানাবে। তবে, তুরস্ক ও ইসরায়েল কী করবে? 

সম্ভবত, কিছু দেশকে পশ্চিমারা শুধু গাজর দেখাবে। কিন্তু সেটা খেতে দেবে না। আর ওই দেশগুলো পশ্চিমা গাজরের লোভে তাদের পক্ষে কাজ করবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র সম্ভবত পশ্চিমা ব্লকে অবস্থান করবে। তবে সক্রিয় লড়াইয়ে যোগ দেবে না। তবে ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান গণহত্যার কারণে আরব জনগণ এই সমর্থন গ্রহণ করবে না।

আফ্রিকান দেশগুলো প্রধানত পশ্চিমা পক্ষের সঙ্গে থাকবে। তবে তাদের সমর্থন কার্যকর ততক্ষণ কার্যকর হবে না যতক্ষণ না তারা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পাঠায় না। সম্ভবত তারা সেটা করবে না। আর বলকানসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো পশ্চিমা ব্লকের পক্ষে থাকতে পারে।

সবশেষে ইসরায়েল ও তুরস্কের অবস্থান নিয়ে আলোচনায় বলা যায়, ইসরায়েল নিঃসন্দেহে পশ্চিমা ব্লকে। তবে, তারা পশ্চিমের জন্য কখনো লড়াই করবে না। ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা নেই যেখানে ইসরায়েলিরা তাদের পশ্চিমা মিত্রদের জন্য যুদ্ধ করেছে। পশ্চিমের জন্য ইসরায়েলিরা যা করেছে এবং অপর দিকে তারা আমেরিকা ও ইউরোপের জন্য যা করেছে তা সহজেই তুলনা করা যায়। অতএব ধরে নেওয়া যায়, ইসরায়েল পশ্চিমের এক ধরনের নীরব সমর্থক হিসেবেই থাকবে।

আর যেহেতু তুরস্ক মনে করছে, তারা বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার। তাই তারা কোনো পক্ষ নেওয়াই পছন্দ করবে না। তুরস্কের জনগণ পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নয়নে অনুপ্রাণিত। তাদের সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও তারা কখনো অন্যায়ের কথা ভুলে যায় না। অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে গাজার ইসরায়েলের চালানো গণহত্যায় সমর্থনসহ নানা কারণেই তুর্কিরা পশ্চিমা দেশগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখে।

তুর্কিরা প্রশ্ন তুলেছে, কেন তাদের সেনাবাহিনী প্যাট্রিয়ট পায় না। কিন্তু রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে পারে? অথবা ন্যাটোর মিত্র ও মার্কিন সামরিক বাহিনী সীমান্তের ওপারে আক্ষরিক অর্থেই পিকেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সিরীয় শাখা ওয়াইপিজির সাথে থাকলেও সীমান্তের এপারে নেই কেন?

তবে, বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও তুরস্ক সম্ভবত পশ্চিমা ব্লকের সমর্থক হবে। যার মধ্যে অস্ত্র সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। যদিও সম্ভবত তুর্কি সৈন্যদের সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হবে না।

‘নেকড়ে শীতকাল পার করে কিন্তু তুষারের কথা কখনো ভুলে না’-এই তুর্কি প্রবাদ দিয়ে তুরস্কের অবস্থান খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। পশ্চিমা ব্লকের বিগত নানা ঘটনার বিরুদ্ধে সন্দেহ ও ক্ষোভ সত্ত্বেও তুরস্ক সম্ভবত পশ্চিমা সমর্থক হিসেবেই নিজেদের পরিচিতি দেবে।

ডেইলি সাবাহ থেকে অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের খবরের সহসম্পাদক শিফা আক্তার বৃষ্টি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর