Logo
Logo

আন্তর্জাতিক

সিরিয়ায় ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য কী

Icon

মুহাম্মাদ শোয়াইব

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৮

সিরিয়ায় ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য কী

ছবি : সংগৃহীত

ইসরায়েল সিরিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ নষ্ট করেনি। তার বিশ্লেষকরা সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঐতিহাসিক হিসেবে দেখেছিলেন। একদিন, যখন বাশার আল আসাদ দামেস্ক থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গোলান হাইটসের বাফার জোনে আক্রমণ চালিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর দুই দিনের মধ্যে, ইসরায়েলি ট্যাঙ্কগুলো বাফার জোন সংলগ্ন সিরিয়ার গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে এবং কৌশলগত পয়েন্টগুলোতে মোতায়েন হয়। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী শুরু করে দামেস্কের ওপর বিমান হামলা, যা সিরিয়ার সামরিক বাহিনীর ভারী অস্ত্র, গবেষণা কেন্দ্র ও অন্যান্য সংবেদনশীল স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে।

এটি আশ্চর্যজনক নয়। কারণ ইসরায়েল একটি প্রতিস্থাপিত ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে সবসময় তার চারপাশের যেকোনো পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। এভাবে ইসরায়েল তার প্রকল্পকে সুরক্ষিত করার জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়টি অনুসরণ করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েল তার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হারিয়েছে, যা বর্তমানে রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে এর প্রকল্পের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অথচ ইসরায়েল তার নতুন কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য, বিশেষ করে ভারী অস্ত্র এবং বিমানবাহিনী সরিয়ে, সিরিয়ার ওপর আরও একটি কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার আরব ও ইসলামি পরিবেশে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করা।

১৯৭৪ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর থেকে সিরিয়া কখনো ইসরায়েলের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেনি, তবে সিরিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এবং সরকারের পতনের পর ইসরায়েল তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়। ইসরায়েল আশা করছে যে সিরিয়ার পরবর্তী সরকার তার সঙ্গে শান্তি এবং স্বাভাবিককরণের প্রক্রিয়া গ্রহণ করবে, অথবা অন্তত তা নিরপেক্ষ থাকবে, যাতে তার অস্ত্র ইসরায়েলের মোকাবেলা না করে।

 এটি লক্ষ্য করা গেছে যে ইসরায়েল গোলান হাইটসে দখলদার সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে এবং ১৯৭৪ সালের বিচ্ছিন্নতা চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে, যা সিরিয়ার সাবেক সরকারের পতনের পর ইসরায়েল ঘোষণা করেছে। যদিও এই পদক্ষেপগুলো অস্থায়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, ইসরায়েল সাধারণত ‘অস্থায়ী’ ব্যবস্থাগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে, যেমন ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার সময় ঘোষিত জরুরি আইন যা আজও কার্যকর রয়েছে।

গোলান হাইটসের চারপাশে আরও সেন্সিটিভ ও কৌশলগত স্থান রয়েছে। বিশেষকরে হারমন পর্বত, যা এখন সম্পূর্ণরূপে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে।

এই আগ্রাসন আসলে ইঙ্গিত দেয় যে ইসরায়েল সিরিয়ায় বর্তমানে যে নতুন সরকার গঠন করছে, তার সাথে আলোচনার জন্য উপযুক্ত নতুন কার্ড অর্জন করতে চায়। এর মাধ্যমে ইসরায়েল তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যতের সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করছে। বিশেষকরে ভারী অস্ত্র ও বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে সিরিয়ার পরবর্তী সরকার, যাই করুক না কেন, ইসরায়েলের উপস্থিতি উপেক্ষা করতে পারবে না। যদি সীমান্তে ইসরায়েলের উপস্থিতি না থাকত, তবে সিরিয়ায় সম্ভবত সিরিয়ার বিপ্লব এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতগুলো এইভাবে বিকশিত হতো না। ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি উদ্বেগ এবং আসাদ সরকারকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার কারণে সিরিয়া আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

তবে যেকোনো আসন্ন সিরিয়ান সরকার ইসরায়েলের উপস্থিতির গুরুত্ব উপেক্ষা করতে পারবে না এবং বিশ্ব প্রতীক্ষা করছে যে সিরিয়া এই উপস্থিতির সাথে কীভাবে মোকাবিলা করবে। গোলান হাইটস ও তার আশেপাশে ইসরায়েলের প্রভাব এখনো গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষকরে হাইয়াতুত তাহরিরিশ-শামের নেতা আহমেদ আশ-শরা, যিনি পূর্বে ‘আবু মুহাম্মদ আল-জুলানি’ নামে পরিচিত ছিলেন, তার স্লোগানের মাধ্যমে গোলান হাইটসের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

বর্তমানে সিরিয়ার নতুন সরকার কীভাবে ইসরায়েলের উপস্থিতি মোকাবিলা করবে তা বেশ কয়েকটি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। প্রথমত, ইসরায়েল তার দৃষ্টিভঙ্গি সিরিয়ার নতুন শাসনের ওপর আরোপ করতে সক্ষম হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুমোদন পেতে চায়। সিরিয়ার ভবিষ্যত সরকার যদি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ না করে, তবে তা ইসরায়েলের প্রতি বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে, হাইয়াতুত তাহরিরিশ-শামকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যাতে সিরিয়ার নতুন সরকার আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন না হয়।

এছাড়াও সিরিয়ার নতুন সরকার ইসরায়েলের ক্রমাগত উস্কানির ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে পারে, যা সিরিয়ার জন্য ইসরায়েলী বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। ইসরায়েলকে এই পরিস্থিতিতে গাজা এবং দক্ষিণ লেবাননে তার ব্যর্থতার মতো এক নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হতে পারে, যেখানে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

এই পরিস্থিতির ফলে ইসরায়েলকে নতুনভাবে বিরোধীদের মুখোমুখি হতে হতে পারে। ইসরাইল তার কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতে পারে, যেভাবে এটি গাজা এবং লেবাননে ইতিমধ্যেই করেছে।

এই দৃশ্যকল্পকে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করা উচিৎ নয়, কারণ সিরিয়ার বিপ্লবী ব্রিগেডে যোগদানকারী যোদ্ধাদের গঠন ইসরায়েলি দখলদার সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। সিরিয়ার নতুন সরকারের সাথে একত্রিত হওয়া এই গোষ্ঠীগুলো, বিশেষকরে যেহেতু ১৯৭৪ সালের বিচ্ছিন্নতা চুক্তি বাতিলের পর থেকে সিরিয়ায় আগ্রাসন শুরু হয়েছে, তারা ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হতে পারে। সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা এখনো পুরো দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে, সিরিয়ার নতুন সরকার যদি ইসরায়েলের উপস্থিতি ও কার্যক্রম উপেক্ষা করে, তবে তা দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ইসরায়েল একটি সম্প্রসারণবাদী ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে সিরিয়ার ভূমিতে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। সম্ভবত ইসরাইল নতুন সিরিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যদিও ইসরায়েল দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া এখনও স্পষ্ট হয়নি, তবে এটি নিশ্চিত যে সিরিয়ার নতুন সরকারকে ইসরায়েলের পদক্ষেপগুলো উপেক্ষা করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

এখানে যে মূল বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো ইসরায়েলের উপস্থিতি সিরিয়ার ভূখণ্ডে একটি নির্ধারক উপাদান, যা সামগ্রিকভাবে সিরিয়ার নিরাপত্তা এবং রাজনীতি প্রভাবিত করবে। ইসরায়েল যদি এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে তার স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, তবে এটি একদিকে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, অন্যদিকে সিরিয়ার নতুন সরকারকেও চিন্তা করতে হবে যে তাদের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা ইসরায়েলের সম্প্রসারণবাদী প্রকল্পের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তাদের কৌশলকে আরও বাস্তবসম্মত ও কার্যকর করবে।

-আলজাজিরা অ্যারাবিক অবলম্বনে

লেখক : মিডিয়া রিসার্চার, এমিরেটস সেন্টার ফর স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ (ইসিএসএসআর), সংযুক্ত আরব আমিরাত

মেইল : [email protected]

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর