আসাদের ৫৬২ কোটি ডলারের মাদক সাম্রাজ্যের এখন কী হবে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২৬
ছবি : সংগৃহীত
স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে বিতাড়িত করার পূর্ব মুহূর্তে সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা আহমেদ আল-শারা দামেস্কে একটি বিজয় ভাষণ দেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে আসাদ সরকারকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তবে সেই ভাষণের একটি অংশ তেমন কারও নজরে আসে নি। সেটা আসাদ সরকারের আমলে গত দশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে বন্যা বয়ে যাওয়া একটি অবৈধ মাদকের প্রসঙ্গ।
ভাষণে আল-শারা বলেন, ‘সিরিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যাপ্টোগান উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। আজ সিরিয়া আল্লাহর রহমতে পবিত্র হতে যাচ্ছে।’
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে তুলনামূলক কম পরিচিত ক্যাপ্টোগান, একটি নেশা জাতীয়, অ্যাম্ফিটামিন জাতীয় মাদক। এটি ‘গরীবদের কোকেন’ নামেও পরিচিত।
যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা এবং সিরিয়ার ব্যাপক অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সংকটের ফলে ভেঙে পড়া অর্থনীতির মধ্যে সিরিয়ায় ক্যাপ্টোগানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ এই মাদকের বিপুল পরিমাণ পাচারের মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
সমস্ত প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে সিরিয়া ক্যাপ্টোগানের অবৈধ বাণিজ্যের প্রধান উৎস ছিল। বিশ্বব্যাংকের ধারণা অনুযায়ী এর বার্ষিক মূল্য ছিল ৫.৬ বিলিয়ন ডলার।
যেভাবে এই মাদকের উৎপাদন এবং পাচার হচ্ছিল, তাতে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল যে এটি কেবল অপরাধী চক্রের কাজ নয়। বরং শাসকগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত একটি শিল্পের কাজ। আল-শারা'র (আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি) ভাষণের কয়েক সপ্তাহ পর কিছু ভিডিও প্রকাশিত হয়। যা এই সন্দেহকে সত্য প্রমাণিত করেছে।
ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, সিরিয়ানরা একাধিক স্থাপনায় হানা দিয়ে আসাদ পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন জায়গায় এমন কিছু কক্ষ খুঁজে পায় যেখানে ক্যাপ্টোগান পিল তৈরি ও প্যাকেটিং করা হচ্ছে। যা নকল শিল্প পণ্য হিসেবে লুকানো ছিল।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, সিরীয় সেনাবাহিনীর একটি বিমান ঘাঁটির ভিতরে এই মাদকের বিশাল স্টক রাখা ছিল, যা বিদ্রোহীরা পুড়িয়ে দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানি সাংবাদিক আমির নাদের বলেন, ‘আমি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একটি তথ্যচিত্রের জন্য ক্যাপ্টোগান সম্পর্কে বছরব্যাপী তদন্ত করে দেখেছি যে কীভাবে মাদকটি সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ধনী যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই মাদক যতটা জর্ডানের মতো দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ঠিক ততটাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ধনবান যুবকদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।’
জর্ডানের রাজধানী আম্মানে একটি পুনর্বাসন ক্লিনিকে মাদকাসক্ত রোগী ইয়াসের বলেন, ‘আমার বয়স তখন ১৯ বছর, আমি ক্যাপ্টোগান নেওয়া শুরু করি এবং আমার জীবন বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে’
তাহলে আল-শারা এবং তার দল হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) কীভাবে সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্যাপ্টোগানে আসক্ত বিপুলসংখ্যক লোকের সাথে মোকাবিলা করবে, হঠাৎ করে যাদের মাদক প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে যাবে?
নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের সিরিয়ার মাদক পাচারের বিশেষজ্ঞ ক্যারোলিন রোজ এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে তারা সত্যিই সরবরাহের উপর কঠোর ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু চাহিদা কমানোর চেষ্টা করবে না।
কিন্তু এখানে আরও একটি বড় প্রশ্ন রয়েছে, সেই বিপুল পরিমাণ লাভজনক বাণিজ্যের ক্ষতি সিরিয়ার অর্থনীতির উপর কী প্রভাব ফেলবে? এবং যারা এর পিছনে ছিল তারা সরে গেলে, আল-শারা কীভাবে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া নতুন অপরাধীদের থেকে নিজেকে রক্ষা করবে?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও আসাদ পরিবারের সদস্যরা এই অবৈধ বাণিজ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত। বিশেষ করে আসাদের ভাই মাহের আল-আসাদ এবং তার সহযোগী জেনারেল ঘাসান বিলাল এই মাদক চক্রের সাথে যুক্ত।
মাহের আল-আসাদ সিরিয়ায় হয়তো তার ভাইয়ের পরে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ২০১১ সালের গণতান্ত্রিক উত্থান দমন করার জন্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর দ্বারা অনেকবার নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছিলেন। যা সিরিয়ার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
২০১৩ সালে সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলার জন্য তাদের দায়ী করে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ফরাসি বিচার ব্যবস্থা।
ক্ষমতা দখলের পর সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এখন এই মাদক বাণিজ্য প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এটি তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কেননা বছরের পর বছর ধরে সিরিয়ার শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতা এই বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে চলেছে।
সিরীয় সেনাবাহিনীর একজন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ইসমাইল আল রেইস ক্যাপ্টোগান বাণিজ্য নিয়ে তদন্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, মাদক পাচার বন্ধ করতে এইচটিএসের খুব বেশি কিছু করতে হবে না। কারণ মূল খেলোয়াড়রা চলে গেছে এবং ইতোমধ্যে ক্যাপ্টোগান রপ্তানি নাটকীয়ভাবে কমে গেছে।
ইসমাইল সতর্ক করেন বলেন, নতুন লোকেরা হয়তো বাণিজ্য পুনরায় শুরু করার অপেক্ষা করছে। চাহিদা কমানো সম্ভব না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
তিনি মনে করেন বর্তমানে আর্থিক সমস্যা সিরিয়ার জন্য একটি বড় বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে মাদকের বাণিজ্যে যুক্ত হওয়া থেকে সিরীয়দের দূরে রাখতে সাহায্য করবে এবং পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা দেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তবে মাদক পাচার বিশেষজ্ঞ ক্যারোলিন রোজ মনে করেন, ইদলিব প্রদেশ নিয়ন্ত্রণের সময় এইচটিএস সেখানে ক্যাপ্টোগান ব্যবহারকারীদের পুনর্বাসনের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেনি।
এছাড়া ইতোমধ্যে সিরিয়ায় অন্য মাদকের পাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় অনেক ব্যবহারকারী ক্যাপ্টোগান ব্যবহারের পর বিকল্প হিসেবে ক্রিস্টাল মেথ গ্রহণ করবে। বিশেষত যারা ইতোমধ্যেই ক্যাপ্টোগানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং নেশার জন্য আরও শক্তিশালী কিছু খুঁজছে।’
রোজ মনে করেন যে, নতুন নেতাদেরকে সিরীয়দের বৈধ অর্থনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য নতুন এবং বিকল্প অর্থনৈতিক পথ চিহ্নিত করতে হবে।
তিনি বলেন, পুরানো অভ্যাস নষ্ট হয় না। যদিও মাদক সাম্রাজ্যের প্রধানরা পালিয়ে গেছে তবুও অনেকেই যারা এই মাদক তৈরিতে এবং পাচারে জড়িত, তারা এখনো দেশের ভেতরেই রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি।
এসবি